ইসাবেল খুঁজে পেয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর পছন্দের লেখার ঘর এক পতিতালয়ে। অনেক খুঁজেও মনের মতো লেখার ঘর আর কোথাও পাননি তিনি। এক বেশ্যাবাড়ির একটি ঘরকে মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন তিনি তাঁর সাহিত্য, ভাষা, ভাবনা সাধনার মগ্ন নিলয় করে! যে বাড়ির সঙ্গে ঘন হয়ে আছে রমণের আঁচ, সেই বাড়িতেই জ্বালিয়ে রেখেছেন তিনি মননের শিখা।
৩০.
চিলির স্প্যানিশ লেখক। নাম Isabel Allende। উচ্চারণ, ইসাবেল আইএন্ডে। যেমন একঘর দেখতে। তেমন এক আকাশ লেখেন। হুড়মুড়িয়ে সম্মোহে পড়তে হয়। আমি পড়েছি। কেউ কেউ বলছে, লেখায় বড্ড খোলাখুলি সেক্স! আমার আবার ওই কারণেই এই উজ্জ্বল বয়সিনীকে বেশি ভালো লাগে।
১৯৪২-এর ২ আগস্টে জন্মানো ইসাবেল এখন ৮৩। যৌনতা নিয়ে কপট আড়াল ইসাবেলের ধাতে সয় না। নিজের যৌন-জীবন নিয়ে কুণ্ঠাহীন লেখা লিখেছেন। পাঠককে হাত ধরে নিয়ে গেছেন লজ্জাহীন বিছানায়। তখন অবশ্য ইসাবেল মধ্য বয়েসে। ওঁর ৯০ বছরের মা রেগে গিয়ে মেয়েকে তিরস্কার করে বললেন, ‘তুই কোন আক্কেলে সেক্স নিয়ে এভাবে খোলাখুলি লিখছিস? সবাই কি ভাববে? সেক্সটা তো প্রাইভেট ব্যাপার। ওটাকে নির্লজ্জ ভাবে পাবলিক করছিস কেন?’ ইসাবেল উত্তরে বলেছিলেন, ‘মা, তুমি বড্ড সেকেলে। আধুনিক পাঠক আড়াল পছন্দ করে না। ওরা চায় রগরগে সত্যি।’
ইসাবেলের বিবিসি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন বিখ্যাত টিভি সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট। যাঁরা এখনও দেখেননি, প্লিজ দেখবেন। সমস্ত সাক্ষাৎকারটা ইউটিউবে আছে। সাক্ষাৎকারে ফ্রস্ট প্রশ্ন করলেন, ‘ইসাবেল, তুমি কত রকমের লেখা লিখেছ! উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিজের জীবন নিয়ে খোলাখুলি লেখা। কত কিছু। কিন্তু এমন কোনও লেখা আছে, যা লিখতে ইচ্ছে, কিন্তু এখনও লেখনি।’ ইসাবেল হেসে বললেন, ‘একটা ইরোটিকা (নিখাদ কামোদ্দীপক লেখা) লিখতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার মা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। আর আমি কোনও দিনই লিখে উঠতে পারব না। তবে খুব ব্যক্তিগত একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মধ্য বয়েসে (তখন ইসাবেল সুন্দরী ৬০) একটা জব্বর পুরুষ পেয়েছি জীবনে। I lust him. And finally I am very happy David. পুরুষটা আমাকে বিশুদ্ধ কামুক করে তুলেছে।’
কিন্তু কামনার কথা আর একটিও নয়। ইসাবেলের লেখায় এবার হৃদয়ের কথা বলব। এমন হৃদয় বর্ণনা, এমন ভাষায় ও চিত্রকল্পে লেখা হৃদয়ের কথা আমি কোথাও কোনও দিন পড়িনি। আপনারা পড়েছেন কি না জানি না। ইসাবেল হৃদয়ের এই বর্ণনা, হৃদয়ের এই হৃদয়বিদারক গল্পটি, যা তাঁর চোখের সামনে ঘটেছে, লিখেছেন তাঁর সেই ক্লাসিক উপন্যাসে, যে উপন্যাসের নামটি তিনি নিয়েছেন পাবলো নেরুদার একটি কবিতা থেকে: ‘আ লং পেটাল অফ দি সি।’ সাগরের একটি দীর্ঘ পাপড়ি।
এবার ইসাবেলের ওই উপন্যাসের অসামান্য গদ্যের একটি ব্যর্থ অনুবাদ: আহত সৈনিক শুয়ে আছে। বয়স ১৬-১৭, তার বেশি নয়। তবু যেতে হয়েছিল যুদ্ধে। মরে গেছে না বেঁচে আছে বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটা কবে আহত হয়েছে, তারও ঠিক নেই। তাকে মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে ডাক্তারের সামনে। ছেলেটার বুকে গুলি লেগেছে।
বুকে যেখানে ক্ষত, সেখানে একটা টিনের প্লেট উলটে ক্ষতটা ঢেকে ব্যান্ডেজ! এবং এই ভাবে ছেলেটাকে ট্রেনে পাঠানো হয়েছে। কতদিনের পথ সে ট্রেনে এই অবস্থায় পেরিয়ে এসেছে, তাও জানা নেই। ডাক্তার ছেলেটার পালস্ দেখল। পালস্ নেই। ডাক্তার মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল, ছেলেটা সব সাহায্যের বাইরে চলে গেছে।
ইসাবেল এর সামনে যেন ঘটছে পরের ঘটনা। ডালমাউ যার বয়স খুব অল্প, সে ডাক্তারকে সাহায্য করে। সেও সরে যেতে পারত ডাক্তারের পিছন পিছন পরের আহত সৈনিকের কাছে। গেল না। তার মনে হল, গুলিবিদ্ধ মৃত কিশোরের মধ্যে বাঁচার ইচ্ছেটা এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে। তাই সে খুব আস্তে তার বুকের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলল। তারপর সে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে দগদগে ক্ষতটার দিকে। যেন ওই কিশোর সৈনিকের বুকে কোনও শিল্পীর আঁকা ক্ষত। ‘Carefully removing the bandage Dalmau saw to his amazement that the wound was still open and was as clean as if it had been painted on his chest.’
এরপর ইসাবেল এর ভাষাতে পড়ুন তাঁর হৃদয় কাহিনি। এবং ভেবে দেখার চেষ্টা করুন, এমন হৃদয়ের কথা আর কোথাও পড়েছেন কি না।
‘Dalmau thought that if the youngster has survived the shock, the hemorrhaging and the journey to reach the station platform, he must really want to live; and so it would be a shame to surrender him to death now. Fascinated, he watched the finally increasingly slow and sporadic pulsation until it ceased completely, and the little soldier finally passed away without a sigh.’
ডালমাউ চুপ করে দাঁড়িয়ে। সে মগ্ন ভাবনায় তাকিয়ে ওই লাল গর্তটার দিকে, যেখানে থেমে গেল হৃদয়স্পন্দন। যুদ্ধের সমস্ত স্মৃতির মধ্যে এই স্মৃতিটা তার মধ্যে সব থেকে অনড় হয়ে থেকে যাবে, ভাবে ডালমাউ। ওই কিশোর সৈনিক। এখনও চকচকে মসৃণ দুটো গাল। পোশাকে ধুলো, ময়লা, কাদা, শুকনো রক্ত। স্ট্রেচারে মেলে দেওয়া দেহ। তার হৃৎপিণ্ড বাতাসে খোলা।
ডালমাউ হঠাৎ তার তিনটে আঙুল জোরে ঢুকিয়ে দিল ওই রক্তাক্ত ক্ষতর মধ্যে! ডান হাতের তিনটে আঙুলের মধ্যে সে টেনে নিল কিশোর সৈনিকের হৃৎপিণ্ড। তারপর সে ওটাকে ক্রমাগত চাপছে আর ছাড়ছে। আর রক্ত গড়িয়ে আসছে। কী আশ্চর্য! হৃদয় চলতে শুরু করল! ফিরে পেল নিজের চলন, গতি, ছন্দ। পিছনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার। বলল, এমন যে ঘটে, ঘটতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। ছেলেটাকে এখুনি হাসপাতালে পাঠাও। ভেরি স্পেশাল কেস। আমি চিকিৎসা শুরু করব।
পড়েছেন কি এমন হৃদয়কথা অন্য কোথাও? অন্য কোনওখানে ? যেতে ইচ্ছে হয় না ইসাবেল আইএন্ডের লেখার ঘরে? লেখার টেবিলটার পাশে? একটি বার হাত রাখতে ইচ্ছে হয় না সেই টেবিলের গায়ে? তাহলে শুনুন এই তুমুল ইসাবেলের এক অদ্ভুত পছন্দ!
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………
ইসাবেল খুঁজে পেয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর পছন্দের লেখার ঘর এক পতিতালয়ে। অনেক খুঁজেও মনের মতো লেখার ঘর আর কোথাও পাননি তিনি। এক বেশ্যাবাড়ির একটি ঘরকে মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন তিনি তাঁর সাহিত্য, ভাষা, ভাবনা সাধনার মগ্ন নিলয় করে! যে বাড়ির সঙ্গে ঘন হয়ে আছে রমণের আঁচ, সেই বাড়িতেই জ্বালিয়ে রেখেছেন তিনি মননের শিখা। আবার যদি কোনও দিন যাই ক্যালিফোর্নিয়ায়, খুঁজে খুঁজে ঠিক যাব সাহিত্য সৃজনের এই বারাঙ্গনা গৃহে, চুমু খাবো আমার থেকে ঠিক এক বছরের ছোটো ইসাবেলের কপালে, তারপর তাঁর লেখার টেবিলে মাথা রেখে চোখ বুঝব নতুন চেতনার কোলে।
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল