দহনের ডাবিং নিয়ে আর একটা ঘটনা বলতে ইচ্ছে করছে। ছবি মুক্তির পর ঋতুপর্ণা, ইন্দ্রাণী হালদার– এদের তো প্রশংসা হলই, কিন্তু সকলে দারুণ অবাক হয়েছিল সুচিত্রা মিত্রের অভিনয় প্রতিভায়। যেমন আভিজাত্যপূর্ণ উপস্থিতি, তেমনই কণ্ঠস্বর। ঘরোয়া আড্ডায় সে-কথা বলাতে ঋতুদার দলবল হেসে কুটোপাটি। এই প্রথম জানলাম, ওটা সুচিত্রা মিত্রের গলা নয়। তবে? সকলে মিলে আমার সঙ্গে খেলতে লাগল। আমি রুমা গুহঠাকুরতা থেকে রমা মণ্ডল– সব বললাম। ফাইনালি মুচকি হেসে ঋতুদা বলল, ‘এটা কেতকী দত্তের গলা!’ আর অসুখে গৌরী ঘোষের গলাটা কার? ঋতুদার আবার হাসি, ওটা আমার গলা, কাউকে বলবি না। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, বলো কী, স্বয়ং গৌরী ঘোষ, ওইরকম আর্শীবাদধন্য এক স্বর, তাঁর গলা তুমি করে দিলে?
৪২.
‘শুভ মহরৎ’-এর শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর মনের ভেতর একটা তোলপাড় চলছিল। একটা মন চাইছিল তক্ষুনি পর্দায় নিজেকে দেখতে, আর একটা মন কুঁকড়ে জবুথবু, জগৎবাসীর কাছে ফাঁসি পরার জন্য প্রস্তুত। সিনেমায় এই এক ঝামেলা! পুরো ব্যাপারটাই এতটা নন-লিনিয়ার, কাটাকুটি না হলে বোঝার উপায় নেই কী দাঁড়াল।
আমার চাকরি জয়েন করতে তখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি। ডাবিং শেষ করে তারপর। ডাবিং নিয়েও একটা ভয় ছিল। ঋতুদা নাকি প্রচণ্ড ধরে ধরে ডাব করায়, একচুল এদিক থেকে ওদিক হতে দেয় না। খোদ ‘দহন’ ছবিরই যা গল্প শুনেছি, আক্কেল যাকে বলে গুড়ুম! তূণীরের যে চরিত্রটা, সঞ্জীব দাশগুপ্ত অভিনীত, ঋতুদা ডাব করিয়েছিল অঞ্জন দত্তকে দিয়ে। ওই একচালেই চরিত্রটা অন্য উচ্চতা পেয়ে যায়। উচ্চতা, কণ্ঠস্বর– সব নিয়েই বহু কমপ্লেক্স ছিল আমার। ফলে মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম, অন্য কাউকে দিয়ে আমার অভিনয় করিয়ে নেবে ঋতুদা। এক মন এটা ভেবে তুমুল বিমর্ষ, অন্য মন খুশি– যাক বাবা, ঘাড় থেকে দায়িত্ব নামল। শেষমেশ অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি, শুভঙ্করের চরিত্রের গিলোটিনে গলা বাড়িয়েছিলাম আমিই।
দহনের ডাবিং নিয়ে আর একটা ঘটনা বলতে ইচ্ছে করছে। ছবি মুক্তির পর ঋতুপর্ণা, ইন্দ্রাণী হালদার– এদের তো প্রশংসা হলই, কিন্তু সকলে দারুণ অবাক হয়েছিল সুচিত্রা মিত্রের অভিনয় প্রতিভায়। যেমন আভিজাত্যপূর্ণ উপস্থিতি, তেমনই কণ্ঠস্বর। ঘরোয়া আড্ডায় সে-কথা বলাতে ঋতুদার দলবল হেসে কুটোপাটি। এই প্রথম জানলাম, ওটা সুচিত্রা মিত্রের গলা নয়। তবে? সকলে মিলে আমার সঙ্গে খেলতে লাগল। আমি রুমা গুহঠাকুরতা থেকে রমা মণ্ডল– সব বললাম। ফাইনালি মুচকি হেসে ঋতুদা বলল, ‘এটা কেতকী দত্তের গলা!’ আর ‘অসুখ’-এ গৌরী ঘোষের গলাটা কার? ঋতুদার আবার হাসি, ওটা আমার গলা, কাউকে বলবি না। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, বলো কী, স্বয়ং গৌরী ঘোষ, ওইরকম আর্শীবাদধন্য এক স্বর, তাঁর গলা তুমি করে দিলে? ‘হ্যাঁ, ওই জন্য একটু অভিমান করেছিল, তারপর ছবি দেখে খুব খুশি হলেন।’
এ গল্প এ-কারণেই বলা, ঋতুপর্ণর ডাব কেলেঙ্কারির সূচনা কিন্তু একদম গোড়া থেকেই। এর ঘাড়ে ওর গলা জোড়ার কাজটা কিন্তু শুরু হয়েছিল প্রথম থেকেই। ডাবিং একটা এক্সপেরিমেন্ট, ডাবিং একটা অপারেশনও। সিনেমার রসায়নাগারে এইসব নিরীক্ষায় সিদ্ধহস্ত ছিল ঋতুদা। কেবল একবার, বিশিষ্ট মেকআপ শিল্পী দেবীদাকে দিয়ে অভিনয় করানোর পর, মুশকিলে পড়েছিল। দেবীদার অভিজাত চেহারার সঙ্গে মানানসই কণ্ঠ মিলছিল না। দেবীদা নিজেও পারছিলেন না। মরিয়া ঋতুদা সৌমিত্রদাকে দিয়ে দু’লাইনের পার্ট ডাব করিয়ে নেয়। একজন লেজেন্ডকে, অন্য কারওর মুখে, মাত্র দু’লাইনের জন্য বেলাইন– এমন খ্যাপামি শুধু ঋতুদারই ছিল।
‘বাড়িওয়ালি’-র ঘটনাটা নিয়ে খুব একটা কথা বলতে চাইত না। আমি পরে দু’-একবার খুঁচিয়েছিলাম। বলেনি কিছু। জাতীয় পুরস্কারের ব্যাপারটা মাঝখানে চলে আসায়, ঝামেলায় পড়ে যায় ঋতুদা। কিন্তু ডাবিং যে একটা চরিত্রকে কোন স্তরে পৌঁছতে পারে– তা আজীবন প্রমাণ করে গিয়েছে। সে আশালতাই হোক বা বিনোদিনী– সুদীপ্তা, শ্রীলার সুকণ্ঠ না বসলে চরিত্রগুলো কিন্তু চোখের বালিই হয়ে থাকত চিরকাল। ঋতুদার ছবিতে ডাবিং এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যা ‘কাল্পনিক’ বলে কখনও চালাতে চেয়েছে হয়তো পরিচালক।
যাক গে, এসব কচকচি ছেড়ে আমার ডাবিং-এর ফর্মায় ঢুকি। আমি বলেছিলাম, একটু বেশিদিন রাখতে। তার কারণ সব কথা অবিকল একইভাবে বলা এবং ঠোঁট মিলিয়ে– ব্যাপারটাই অবাস্তব ঠেকছিল আমার। ঋতুদা অভয় দিল, ‘আয়ই না’। কনসোলে ঋতুদা ছাড়া মন্টুদাও ছিল। নতুন করে অ্যাক্টিং করতে গিয়ে দেখলাম, দারুণ মজা তো, যা বলছি প্রায় সবেতেই খুশি হচ্ছে ঋতুদা। মিলেও যাচ্ছে বেমালুম। যে কাজ করতে ভেবেছিলাম দিন চারেক লাগবে, লাঞ্চের আগেই সেই কাজের অর্ধেকটা নামিয়ে দিয়েছিলাম।
ঋতুদা প্রশংসাও করল। বলল, ‘ভালো ডাব করেছিস, অ্যাকসেন্ট এবং পজগুলো ঠিক হচ্ছে।’ কিন্তু অ্যাকিউরেট হচ্ছে কি? জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে ঋতুদা একটা দামি কথা বলেছিল। ‘মূল পারফরম্যান্সের একশো শতাংশ করা কোনও অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায়। আর তোরটা অ্যাকিউরেট হচ্ছে কি না বোঝা খুব মুশকিল, তার কারণ দাড়ি গোঁফের এইরকম ঝাড়। ঠোঁটই দেখা যাচ্ছে না, তো বুঝব কী করে? আর যদি আমি বুঝতে না পারি, জানবি আর কেউ বুঝতে পারবে না।’ মন্টুদাও মিচকি মিচকি হাসতে লাগল। আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। দাড়ি-গোঁফের এই বিশাল বাদাবন, এই প্রথম এতটা কাজে আসল আমার।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
……………………………………………
লাঞ্চের পরের দু’ঘণ্টায় শুভঙ্করের ডাবিং শেষ। ফিল্ম সার্ভিস স্টুডিওতে সংলাপ গ্রহণের কাজটা করেছিলেন আর এক দিকপাল সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার– অনুপ মুখোপাধ্যায়। তিনি ডাবিং সেশনের নানা মজার গল্প বলেছিলেন। প্রসেনজিৎ কেন চিবিয়ে কথা বলে, সে রহস্যও ফাঁস করেছিলেন। দাঁতে দাঁত চিপে কথা বললে নাকি সব সংলাপই মিলে যায় বেমালুম।
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪১: ঋতুদার ভেলকিতে খুনের থেকেও প্রেমের জখম বড় হয়ে দাঁড়াল
পর্ব ৪০: আমার ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিল সইফ আলি খান
পর্ব ৩৯: নন্দিতার জন্য নার্ভাস ছিলাম না, রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিলাম
পর্ব ৩৮: টোটার দেওয়া ডায়েট চার্ট পেয়ে নিজেকে হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল
পর্ব ৩৭: ফিরে এল কলেজবেলার কমপ্লেক্স– নন্দিতা দাস আমার চেয়ে লম্বা নয়তো?
পর্ব ৩৬: আমার ডিটেকটিভ একজন মহিলা, বলেছিল ঋতুদা
পর্ব ৩৫: চন্দ্রবিন্দুর কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে হবে না!
পর্ব ৩৪: বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, চ অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?
আমি যখন মস্কোয় ছিলাম, সেই সময় ইলাদি মস্কোয় এসেছিলেন, কিন্তু তখন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, উনি এসেছিলেন আরও কয়েকজন কমরেডের সঙ্গে মস্কোর পার্টি-স্কুলে মাস ছয়েকের জন্য মার্কসবাদ-লেলিনবাদের একটি শিক্ষাশিবিরে যোগ দিতে। উনি যে এখানে এসেছেন, তা দেশেও অনেকেই জানে না। সংবাদটা গোপনীয়।