বাইরে একটা প্রচণ্ড চিৎকার শুনলাম। হোটেলের ম্যানেজার হতভম্ব মুখে এসে দাঁড়ালেন। ভিড়ের চাপে ম্যানিলার কাচের দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। ঋতুদা-সহ বাকি ইউনিটের মুখ শুকনো অপরাধী। তারই মধ্যে দেখি, বয়স্ক এক লাইটম্যান একগাল হেসে হাততালি দিচ্ছেন। বলছে, ‘ছবি হিট, ছবি হিট!’ শুটিংয়ের সময় নাকি কোনও কিছু ভাঙা খুব শুভ, ইন্ডাস্ট্রির সংস্কার এমনই। কে জানে, ওইজন্য হয়তো নারকেল ভেঙে শুরু হয় প্রথম দিনের শুটিং। ঋতুদার নিশ্চয়ই এই কাণ্ডটা মনে ছিল। নইলে শুভ মহরতে এমন একটা সংলাপ গুঁজে দেবেই বা কেন?
২২.
বর্ষায় পাহাড়ের এক অন্য সৌন্দর্য। জল ঝরছে অবিরাম চারিদিক থেকে, যেন জন্মাবধি বোবা কোনও মানুষ হঠাৎ কথা বলতে পারছেন কোনও অলৌকিক কৌশলে। না-বলা গল্প ঝরে পড়ার মতো নানা জলমুখ কথা বলে উঠছে হঠাৎ। আমাদের গাড়িগুলো গোত্তা খেতে খেতে প্রতিটি বাঁকের মুখে থতমত, কেননা পাহাড়ের গা দিয়ে অনর্গল ধারায় কথারা নামছে। কেউ না কেউ ড্রাইভারকে চেঁচিয়ে বলছে, সাবধান, রোককে। সাবধান হওয়া আর বেঁচে থাকা এক জিনিস নয়, জলের ঝাপটা না খেলে বুঝব কী করে জীবনের সৌন্দর্য। সমতলের কাজ শেষ করে ইউনিট একসঙ্গে উঠছে পাকদণ্ডি বেয়ে। সেবক ব্রিজ ক্রস করার পর থেকে একটানা বৃষ্টির শব্দ আর অল্টিটিউড কানে ভোঁ ধরিয়ে দিয়েছে। সুদেষ্ণা রায়, অনেকক্ষণ ধরে সামনের সিট থেকে কী একটা বলছে, বুঝতে পারছি না ভালো। কান খাড়া করে শুনলাম, ঋতুদাকে নিয়ে কিছু একটা বলতে হবে। সুদেষ্ণাদি ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর রকমারি পাতাটা দ্যাখে, সেখানেই লিখবে। ‘কী বলব?’ ‘তোর যা ইচ্ছে বলবি ঋতুদাকে নিয়ে।’
আমাদের গন্তব্য লাভা। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন ম্যাপে লাভা-লোলেগাঁও সেসময় নতুন সংযোজন। দুঃসাহসীরা উঠে যাচ্ছে রিশপ পর্যন্ত, মানুষ পৌঁছলেও সেখানে তখনও ইলেক্ট্রিসিটি পৌঁছয়নি। রিশপে কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য তোলার কথা। আমাদের লোকেশন রেঞ্জটা লাভা থেকে লোলেগাঁও-এর পথ। পাহাড়ে ওঠার আগে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হয়েছে। নতুন হওয়া ম্যানিলা হোটেলের ক্যাফেতে কিছু শট হচ্ছিল মিঠুন চক্রবর্তীর। আমি একটু তফাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার নাম ধরে ঋতুদা মাইকে ডাকাডাকি করছে। এই রে! আবার কী করলাম? ঋতুদা আমায় দেখে বলল, ‘অনিন্দ্য, তুই ওই চেয়ারটায় বোস তো একবার। মিঠুন যেটায় বসে আছে, তার পাশেরটায়।’ আমি বসে পড়লাম। ওমা, তারপর দেখি মনিটর চলছে। ক্যামেরা যখন চলে তখন বোঝা দায়, কে কখন সামনে-পিছনে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, ‘করবটা কী?’ ঋতুদা ধমক দিল, ‘কফিটা খাবি চুপচাপ।’ বুঝলাম। আউট অফ ফোকাসে কোথাও ফ্রেমে ঢুকে পড়েছি আমি। মন দিয়ে কফি খেলাম, একবারের জায়গায় তিনবার চুমুক চালালাম। শট ‘ওকে’ হয়ে যাওয়ার পর ঋতুদাকে জিজ্ঞেস করতে যাব কেমন হয়েছে, বাইরে একটা প্রচণ্ড চিৎকার শুনলাম। হোটেলের ম্যানেজার হতভম্ব মুখে এসে দাঁড়ালেন। ভিড়ের চাপে ম্যানিলার কাচের দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। ঋতুদা-সহ বাকি ইউনিটের মুখ শুকনো অপরাধী। তারই মধ্যে দেখি, বয়স্ক এক লাইটম্যান একগাল হেসে হাততালি দিচ্ছেন। বলছে, ‘ছবি হিট, ছবি হিট!’ শুটিংয়ের সময় নাকি কোনও কিছু ভাঙা খুব শুভ, ইন্ডাস্ট্রির সংস্কার এমনই। কে জানে, ওইজন্য হয়তো নারকেল ভেঙে শুরু হয় প্রথম দিনের শুটিং। ঋতুদার নিশ্চয়ই এই কাণ্ডটা মনে ছিল। নইলে শুভ মহরতে এমন একটা সংলাপ গুঁজে দেবেই বা কেন?
লাভা এসে পৌঁছলাম বিকেল চারটেয়। তখনই এমন মেঘ ও কুয়াশা দেখা যাচ্ছে না কোনও কিছু। মাঝে কয়েক সেকেন্ডের জন্য টুকরো ট্রেলার। ভালো করে কিছু বোঝার আগেই ঢেকে গেল সব। লাভা এলে যতটা ভালো লাগা উচিত ছিল, ততটা লাগল না। এ জায়গা সভ্যতার থেকে শতহাত দূরে, ফোন করাই কষ্টসাধ্য, ইমেল তো বহু দূর! যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক স্যাঁতসেঁতে দ্বীপে এখন ‘তিতলি’র তাঁবু পড়ল, দেখা যাক কপালে কী নাচছে!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নতুন হওয়া ম্যানিলা হোটেলের ক্যাফেতে কিছু শট হচ্ছিল মিঠুন চক্রবর্তীর। আমি একটু তফাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার নাম ধরে ঋতুদা মাইকে ডাকাডাকি করছে। এই রে! আবার কী করলাম? ঋতুদা আমায় দেখে বলল, ‘অনিন্দ্য, তুই ওই চেয়ারটায় বোস তো একবার। মিঠুন যেটায় বসে আছে, তার পাশেরটায়।’ আমি বসে পড়লাম। ওমা, তারপর দেখি মনিটর চলছে। ক্যামেরা যখন চলে তখন বোঝা দায়, কে কখন সামনে-পিছনে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, ‘করবটা কী?’ ঋতুদা ধমক দিল, ‘কফিটা খাবি চুপচাপ।’ বুঝলাম। আউট অফ ফোকাসে কোথাও ফ্রেমে ঢুকে পড়েছি আমি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সে-সময় লাভায় খুব যে উন্নতমানের হোটেল ছিল, তা-ও নয়। থাকার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের লগ হাউসগুলো। সেগুলো আমরা পাইনি। এবারে ঋতুদার হোটেলেই আমরা পুরো ডিরেক্টোরিয়াল টিম। আমি আর সারণ যথারীতি রুমমেট। মিঠুন চক্রবর্তী, অপর্ণা সেনরা কোথায় থাকতেন, সে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। তবে ঋতুদা থাকত বলে, শুটিং শেষে এই আমাদের হোটেলে আড্ডা বসত। যা বুঝলাম, প্রতিদিনই বিকেল চারটের পর থেকে ঝুপ অন্ধকার। ডিনার দিতে দিতে রাত ৮-৯টা। এতখানি বেকার সময় করবটা কী ভেবে আতঙ্ক হচ্ছে! সারণের সঙ্গে গল্প করা যাবে না। এক দিস্তে কাগজ নিয়ে ও নাকি সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখছে। হাতে পাউচ সিগারেট, সামনে বুড়ো সাধুর পেসাদ। একটু লেখে, বেশিরভাগটাই ছেড়ে। এমন গুরুতর কাজে ওকে ডিসটার্ব করা যায় না। আফটারঅল শিল্প হচ্ছে। ঘরটা ধোঁয়ায় ধোঁয়া, ভয়ে ভয়ে থাকতাম, এই বুঝি হাঁপের টান উঠল। যা ঠান্ডা, মোটা কম্বলেও জুবুথবু। এখানে আরও একমাস থাকতে হবে ভেবে, একরাশ বিষণ্ণ কুয়াশা মনের ভেতর।
পরদিন সকাল অবশ্য সব ভুলিয়ে দিল। বিস্তীর্ণ পাইন গাছের সারি, তার ফাঁক দিয়ে কমলা লাঠির মতো রোদ, কুয়াশার বুক ঠেলে জেগে উঠছে সবুজ এক প্রান্তরের গান, এমন প্রকৃতির দিকে নির্মিমেষ চেয়ে থাকলে শুটিংয়ের কথা মনে পড়ে না বিলকুল। হঠাৎ কোথা থেকে হেডমাস্টারের মতো সুদেষ্ণাদির আগমন। ‘এই শিগগির বল ঋতুকে নিয়ে, দুটো লাইন।’ আমি ভেবে রেখেছিলাম। মুখটা যতটা সম্ভব সিরিয়াস করে বললাম, ‘মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত। প্রথমে বাড়িওয়ালি… এখন তিতলি…এরপর করবে চোখের বালি। ঋতুদার এখন লি ফেজ চলছে।’
সুদেষ্ণাদি হো হো করে হাসল। জানতাম না, ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ ওটাই পরে হেডিং করে দেবে।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?