প্রায় নিয়মিত তখন লিখতে শুরু করেছি। জানি কিছুদিন পর জয়েন করব এখানেই। একদিন ঋতুদার ঘরে বসে। বাল্মীকি এসে নতুন সংখ্যা দিয়ে গেল। সেই ইস্যু থেকে আনন্দলোক পাল্টালো। ‘উল্টে দেখুন পাল্টে গেছে’– সেই সময়কার ক্যাচলাইন। ঋতুদা প্রবল উৎসাহে বইটা আমায় দেখাচ্ছিল। হঠাৎ কোন একটা পাতায় গিয়ে থমকে গেল। একটা ফিচার যাওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে।
২৮.
ঋতুদার ফোন করার সময়টা খুব ভয়ের ছিল। সকাল ছ’টা থেকে উঠে পড়ে রাজ্যের কাজ সেরে ফোন নিয়ে বসত। যেন যত দরকার তখনই সব মনে পড়ত। তখন তো আর আমার মোবাইল গজায়নি। বাড়ির ফোন টিয়াপাখির মতো কর্কশ স্বরে ডাকাডাকি করত। অত ভোরে ফোন বাজা মানেই ঋতুদা। দরকারগুলো খুব জরুরি ছিল না। কোন গানের কথায় কী লিখেছি, কেন ‘আমার শহর’-এ ওই ইভেন্টটা কভার করিনি– এইসব। কাঁচা ঘুম ভেঙে সংস্কৃতি চর্চা করতে বিরক্তই লাগত কিন্তু আফটার অল ঋতুপর্ণ ঘোষ– কী করা যাবে! শুধু একদিনের ফোনটা ভীষণভাবে মনে আছে। ‘তুই কি আনন্দলোক জয়েন করতে চাস?’ এই প্রশ্নটা আকাশ থেকে নেমে আসা আশীর্বাদের মতো। একে তারা-র চাকরির অস্থিরতা, অন্যদিকে ঋতুদার সঙ্গে কাজের সুযোগ। ডিরেক্টর হিসেবে তেমন কিছুই করে উঠতে পারিনি আমি। কিন্তু লেখালেখির ক্ষেত্রে একটা আলগা আত্মবিশ্বাস আছে আমার। মনে হয়েছিল, ভালো কিছু করতে পারব। তাই দৃঢ় স্বরে জবাব দিলাম, ‘চাই’। কথাটা বলেই খুব খারাপ লাগতে শুরু করল। সবে শুরু হয়েছে আমার শহর প্রোগ্রাম। এতগুলো মানুষ সেই প্রোগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে। ‘সব ফেলে চলে যাব?’ ঋতুদাকে বললাম। ঋতুদা বলল, ‘ওমা, এ আবার ভাবার কী আছে, অন্য কেউ করবে। আমি কথা বলে নিচ্ছি, তুই ঝোলাস না।’ জীবন নতুন কোনও ইয়ার্কি শুরু করল আবার।
‘আমার শহর’ অনুষ্ঠানে ক্যামেরা করত দু’জন– দেবলীনা ও তন্ময়। যেহেতু অনেকগুলো বিভাগ ছিল, প্রয়োজন ছিল একাধিক লোকের। দেবলীনা আমায় বলল, যাদবপুরের বন্ধুরা খুব ভালো গান করে, একটা এপিসোডে ওদের দেখানো যায় কি না?
–কী গান করে? নিজেরা লেখে?
দেবলীনা জানাল, লোকগীতি গায়। দল বেঁধে। চলোই না, ভালো লাগবে তোমার।
–আগে নাম বল তোর বন্ধুর, তারপর দেখছি।
–ওর নাম কালিকাপ্রসাদ, আমরা ‘কালিকা’ বলে ডাকি।
নাম শুনে আমি হাসতে লাগলাম। “এ-যুগে এর’ম কারও নাম হয়?”
দেবলীনা রেগে গেল, চট করে রেগে যাওয়া ওর হবি ছিল। ‘ও শিলচরের ছেলে, খুব বড় পরিবারের। নাম শুনে হাসবে না একদম।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এর বহু বহু দিন পর ‘চন্দ্রবিন্দু’ কোনও একদিন শিলচরে অনুষ্ঠান করতে যাবে। সে অনুষ্ঠানের ডাক আসবে অমল হাসির কালিকার কাছ থেকেই। আরও কত কত সব গল্প, রসিকতার সন্ধেরা মিশবে। একটা সময় আসবে যখন অভীক, কালিকা আর আমি মিলে মিটিং-এর পর মিটিং, আড্ডার পর আড্ডা দেব। কালিকাকে মজা করে বলতাম, তুমি কিন্তু ছোটদের বলে দেবে, যেন দাদা না বলে তোমায়, নইলে সবাই ‘কালিকাদা’ বলে ডেকে কালি-কাদা ছিটিয়ে চলে যাবে। ট্রেডমার্ক হাসিটা দিত। ধুলো বালি উড়িয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে উধাও হয়ে যাওয়াটা মনে রাখার দরকার নেই, হাসিটুকু থাক।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তো, দেবলীনা টেনে নিয়ে গেল কালিকাদের ছাদে। সেই প্রথম ‘দোহার’ শুনলাম। ‘কী দুগ্গি দেখলাম চাচা’– গানটা নিমেষে ভালো লেগে গেল। একটা বেটা ক্যামেরা দিয়ে ছাদের এ-মুড়ো ও-মুড়ো শুটিং হল। আমি কালিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের ব্যান্ডের নাম কী?’ অমায়িক হেসে তার জবাব, ‘‘দাদা, ব্যান্ড বলি না আমরা। বাংলা গানের দল। আমাদের এক মাস্টারমশাই দলের নাম দিয়েছেন ‘দোহার’।’’ সেই মাস্টারমশাইকে ঘটনাচক্রে আমিও চিনতাম। এককালে ‘আনন্দমেলা’-য় একসঙ্গে ফ্রিলান্স করা, দস্তুরমতো ‘ফাজিল’ (পণ্ডিত অর্থে ব্যবহার করলাম কিন্তু) অভীক মজুমদার। কালিকা-রাজীব-অমিতদের সঙ্গে সেই আলাপের শুরু। আরও অনেক আড্ডার সূত্রপাত যে ওই ছাদ থেকেই হবে, জানা ছিল না। এর বহু বহু দিন পর ‘চন্দ্রবিন্দু’ কোনও একদিন শিলচরে অনুষ্ঠান করতে যাবে। সে অনুষ্ঠানের ডাক আসবে অমল হাসির কালিকার কাছ থেকেই। আরও কত কত সব গল্প, রসিকতার সন্ধেরা মিশবে। একটা সময় আসবে যখন অভীক, কালিকা আর আমি মিলে মিটিং-এর পর মিটিং, আড্ডার পর আড্ডা দেব। কালিকাকে মজা করে বলতাম, তুমি কিন্তু ছোটদের বলে দেবে, যেন দাদা না বলে তোমায়, নইলে সবাই ‘কালিকাদা’ বলে ডেকে কালি-কাদা ছিটিয়ে চলে যাবে। ট্রেডমার্ক হাসিটা দিত। ধুলো বালি উড়িয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে উধাও হয়ে যাওয়াটা মনে রাখার দরকার নেই, হাসিটুকু থাক।
নতুন বাংলা গানের আরও সব কারিগরের সঙ্গে পরিচয় হল। কাঁকুড়গাছি মোড়ে রিহার্সাল করত তূণীর– অনির্বাণ, অরিজিৎ, মৃগাঙ্ক। দুরন্ত সব গান ছিল ওদের তূণীরে। ‘একুশে পা’ দলটার ভিডিও তুলতে গিয়েছিলাম দমদম। রাজর্ষি, শিবব্রত সবাই মিলে তারুণ্যে ঝলমল এক বিকেল। অনির্বাণ এখন দুঁদে সাংবাদিক, অভিনেতা। অরিজিৎ আর জে। রাজর্ষি পরিচালক। শিবব্রত ‘তাকে অল্প কাছে ডাকছি’ গানটার কম্পোজার, এখন চন্দ্রবিন্দু-তে আমার সহকর্মী।
‘আনন্দলোক’ দপ্তরে যাতায়াত বাড়ল। প্রায় নিয়মিত তখন লিখতে শুরু করেছি। জানি কিছুদিন পর জয়েন করব এখানেই। একদিন ঋতুদার ঘরে বসে। বাল্মীকি এসে নতুন সংখ্যা দিয়ে গেল। সেই ইস্যু থেকে আনন্দলোক পাল্টালো। ‘উল্টে দেখুন পাল্টে গেছে’– সেই সময়কার ক্যাচলাইন। ঋতুদা প্রবল উৎসাহে বইটা আমায় দেখাচ্ছিল। হঠাৎ কোন একটা পাতায় গিয়ে থমকে গেল। একটা ফিচার যাওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। যিনি দায়িত্বে ছিলেন পাতাটির, তাকে ডেকে শুরু হল ঝাড়। রেগে গেলে ঋতুদা যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ। সম্পাদকীয় বিভাগের সেই মহিলা বয়সে ঋতুদার চেয়ে অনেকটাই বড়। ঋতুদার কালবৈশাখীর সামনে বেশ কয়েকবার ‘সরি ঋতু’ ‘সরি ঋতু’ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না। আমার তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! এই সিচুয়েশনটা আরও খারাপ হচ্ছে, আমি একজন আউটসাইডার, রয়েছি বলে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া ভদ্রমহিলার স্বামী তারাতেই দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। ফলে যা হওয়ার তা-ই হল, দিনকয়েক বাদেই তারাতে আমি শো-কজ খেলাম।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?