একসময় বেশ কিছুদিন মানসিক অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতালে বায়না ধরলেন, আমার এখানে স্কেচখাতা চাই। স্কেচখাতা দেওয়া হয়েছিল। বেডে বসে বসে অন্যান্য রোগীদের আচার-আচরণ, তাঁদের ওঠাবসা ছবিতে আঁকতেন। মাঝে মাঝে মাথায় ভূত চাপত। পাহারাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে চলে যেতেন। পিজি হাসপাতাল থেকে একবার উনি গভীর রাতে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন রেসকোর্সের দিকে। রাস্তায় বেরিয়ে গেটম্যান ঘুমোচ্ছে সেটাও স্কেচ করেছিলেন। আমরা বায়না ধরেছিলাম, একদিন দেখান না সেই হাসপাতালের স্কেচখাতা। উনি সত্যি সত্যি একদিন এনেছিলেন। সেই স্কেচখাতা থেকে ছবি দেখালেন, ছবির গল্প শোনালেন। যেটা সবচেয়ে অবাক হওয়ার, সেটা হল, সমস্ত ছবির নীচে সই করেছেন– ‘পাগল ঘোষ’।
৩৯.
আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরেই আমাদের ছোট করে র্যাগিং-ট্যাগিং হয়ে গেল। সেটার অসোয়াস্তি কমাতে একদিন নবীনবরণ উৎসবের আয়োজন। সিনিয়র-জুনিয়রদের পরিচয় এবং মিলন উৎসব। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ছিলেন মাস্টারমশাইরাও। অনাড়ম্বর উৎসব, গল্পগুজব, একটু মিষ্টিমুখে আলাপ পর্ব। সেদিন একজন মাস্টারমশাইকে বেশ মনে ধরেছিল, তিনি গোপাল ঘোষ। না, পোশাক-আশাক বা চেহারায় মনে ধরার মতো কিছু ছিল না। অতি সাধারণ চেহারা, পাট করা চুল, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। তিনি যে শিল্পী হিসেবে খুব বিখ্যাত, সে খবরও তখন জানা ছিল না। ঘটনাটা এমন ঘটল যে মনে রাখার মতোই। ছাত্র ও শিক্ষকদের কিছু কিছু বক্তব্য রাখার পরেই ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান, সুনীল পাল, গোপালবাবুকে বললেন, ‘মাস্টারমশাই আপনিও কিছু বলুন’। গোপালবাবু উঠে দাঁড়ালেন এবং পাঞ্জাবির ঝুলটা টেনেটুনে ঠিক করে, আমাদের উদ্দেশে বললেন, ‘খুব কাজ করে যাও, ব্যস’। ওইটুকুই তাঁর বক্তৃতা। জীবনে এত স্বল্পদৈর্ঘ্যের বক্তৃতা বোধহয় ওটাই প্রথম, ওটাই শেষ শুনেছিলাম। কিন্তু ওই যে, ‘খুব কাজ করে যাও‘ ব্যাপারটা ভুলতে পারিনি। এখন পরিণত বয়সে বুঝতে পারি, কতটা কাজ করলে তবে কাজটা থেকে নিজে নিজেই শেখা যায়।
সেকেন্ড ইয়ারে আমরা পেয়েছিলাম মাস্টারমশাই গোপালবাবুকে। উনি আমাদের মন থেকে আঁকা, কম্পোজিশন ইত্যাদি শেখাতেন। একটি ঘরেই একদিকে স্টিল-লাইফ, আরেকদিকে এই ‘মেমোরি ড্রয়িং’ বলে একটা জিনিস। মন থেকে আঁকা এবং রং করা। তার সাপোর্টিংয়ে আমাদের আউটডোরে যেতে হত। অতএব খোলামেলা, যে যার মতো কাজ। তেমন কোনও ভারী ভারী লেকচার নেই। না ছিল খুব একটা গ্রামারের কচকচানি। তখনই শুনেছিলাম, জলরঙে নাকি ওঁর খুব নাম, অথচ আমাদের কখনও হাতে-কলমে জলরং শেখাতেন না, বলতেনও না কিছু। কাজ দেখতেন। কাজ দেখে ওঁর স্বভাবসিদ্ধ খুব অল্প কথাই বলতেন, সেটাই যা পাওয়া।
আমি তখন কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ীর বাড়িতে যাতায়াত করি। সেইখানে গোপালবাবুর দুটো ছবি দেখেছিলাম। তার কোনওটাই জলরং নয়। চণ্ডীদা বলেছিলেন, গোপালবাবু যত বিখ্যাত জলরঙের ছবির জন্য, ততটাই বিখ্যাত প্যাস্টেলে আঁকা ছবির জন্যও। আলাদা করে ওই ছবি দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম, এটাও একটা মাধ্যম। মনে পড়ল, খুব ছোটবেলা থেকে আমরা যে মোম রং দিয়ে কাজ করতাম, যাকে ‘ক্রেয়ন’ বলে, সেটাকেই পরবর্তীকালে ওই কাগজে মোড়া তেল রঙের খড়ি বা চক। অয়েল প্যাস্টেল। আরও পরে শুনেছি ড্রাই প্যাস্টেল। আমার সুযোগটা হল, গোপালবাবুর ছবিটায় আমি প্রায় নাক ঠেকিয়ে দেখতে পাচ্ছি তাঁর স্ট্রোক্স, তাঁর বড় জায়গা ভরা, রঙের ডিপোজিশন, রংগুলোকে কীভাবে লাগানো হয় ইত্যাদি। সেগুলো কিন্তু আমরা ছোটবেলায় যা করেছি, তার ধারেকাছেই নয়।
চণ্ডীদার বাড়িতে ওই প্যাস্টেলে আঁকা নিসর্গদৃশ্য দেখে স্বভাবতই ঘরে ফিরে এসে প্রথম কাজ, এক বাক্স অয়েল প্যাস্টেল কিনে ফেলা। কিনলাম এবং সেটা দিয়ে ছবি এঁকেও ফেললাম। নিজের মতো করে যা পেরেছিলাম। গাছপালা আকাশ ইত্যাদি। হলে কী হবে! দারুণ হতাশা। ছোটবেলায় এই মোমরঙেই তো সবকিছু এঁকেছি। তখন সব ঠিকঠাক ছিল, এখন কী হল! না আঁকতে পারছি মেঘ, না গাছ। রঙের জেল্লাও নেই।
প্যাস্টেলে আঁকা দু’-একটা কাজ নিয়ে একদিন ভয়ে ভয়ে গোপালবাবুর কাছে ক্লাসে গিয়ে দেখালাম। অনেকক্ষণ ধরে সেটা দেখলেন মাস্টারমশাই। তারপরে ছবিটা নিয়ে উনি পাশে বসে থাকা আমাদের দ্বিতীয় বর্ষের আরেকজন শিক্ষিকা অমলাদিকে দেখালেন এবং বললেন, ‘সুন্দর হয়েছে না?’, আবার নিজের হাতে নিলেন এবং আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নখের কোণে ব্যথা করে?’ আমি কিছু বুঝলাম না। উনি আর একবার বললেন, ‘নখের কোনায় ব্যথা করবে’।
আমি আসলে প্যাস্টেলের গায়ের যে কাগজ জড়ানো থাকে, সেটাকে অল্প করে ছিঁড়ে, ঠিক যেমন করে রাস্তায় আমরা রোল খাই আর কী, সেরকম প্রয়োজনমতো কাগজ ছিঁড়ে রঙের যেটুকু মুখ বেরয়, সেটুকু দিয়ে খুব সন্তর্পণে রং করেছিলাম। আস্তে আস্তে, ঘষে ঘষে, বড় জায়গাকে ভরাট করেছিলাম। দামি রং কেনার পয়সাকড়ি তখন কম, তাই যতটা সম্ভব নষ্ট না করে, অল্প রঙে বেশি জায়গা ভরাট করার চেষ্টা। গোলমাল সেখানেই। চণ্ডীদার বাড়িতে গিয়ে আমি আবার দেখলাম সেই ছবি। দেখলাম যে এরকম হালকা, যাকে বলে একেবারে কাগজের ওপরে ভেসে থাকার রঙে আঁকায় ছবি জমানো যায় না।
প্রয়োজনে প্যাস্টেলটির কাগজের জামা খুলে নিতে হয়। দু’হাতে পট করে ভেঙে দু‘ভাগে ভাগ করে তার একটাকে নিয়ে, ডগা দিয়ে নয়, সারা প্যাস্টেলের শরীরটাই আড়াআড়িভাবে কাগজে রেখে হাতের চাপে যতটা সম্ভব জোর করে, ঘন করে জমি ভরাট করার ব্যাপার। তেমনি আরও টুকরো করে ভেঙে, আঙুলে চেপে রংগুলো কাগজে লাগানোর দরকার হতে পারে। অর্থাৎ, কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যতক্ষণ না পৌঁছনো যাচ্ছে ততক্ষণ এটাকে গায়ে-গতরে খেটে, যুদ্ধ করে যেতে হবে। তার ফল– নখের কোনে ব্যথা করবে।
সেকেন্ড ইয়ারে পড়াকালীনই আমি সৌভাগ্যবশত বিখ্যাত শিল্পী অতুল বসুর বাড়িতে যেতাম প্রতি রোববার। তিনি বৃদ্ধ বয়সে আমাদের আঁকা শেখাতেন। সেখানে হাতে-কলমে কীভাবে প্যাস্টেল দিয়ে ছবি আঁকতে এবং প্যাস্টেলের রংটা পটে ট্রান্সফার করতে হয়, সেটা দেখেছিলাম। কীভাবে রং লাগাতে হয় উনি সেটা করে দেখিয়েছিলেন একটা ছোট্ট কাঠের পাটায়। আরও একটা জিনিস জানলাম, প্যাস্টেল শুধু কাগজে নয়, কাঠে, ক্যানভাসেও করা সম্ভব। সেইটা দেখেও মনে মনে গোপালবাবুর কথা ভাবলাম। মাস্টারমশাইকে অন্যভাবে চিনলাম।
প্রসঙ্গত, আমরা যখন আর্ট কলেজে পড়ি, অদ্ভুতভাবে তখন আর্ট মেটেরিয়ালের দোকানে যা কিছু জিনিস কিনতে পেতাম সেগুলোর বেশিরভাগটাই বিদেশি। কারণ সময়টা। আমরা যখন জন্মেছি তার অল্প আগেই ভারত স্বাধীন হয়েছে। তাই স্বদেশি বা দেশি জিনিসপত্র চট করে বাজারে আসেনি। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন শিল্প-সামগ্রী ইত্যাদিতে আরও সময় লাগবে। তাই আমরা যা ভালো কাগজ, রং, তুলি ইত্যাদি ব্যবহার করতাম সেগুলো প্রায় সবটাই বিদেশি, ইংরেজ আমলে ব্যবহারের অবশিষ্টাংশ। এখন ভাবি, আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে কোন এলাকায় বিচরণ করছিলাম।
বস্তু এবং পদ্ধতিগত দিক তো হল। মনের ভাব কিংবা মানসিক অবস্থার প্রতিফলন কীভাবে ছবিতে আসবে? সেটা যদিও অনেকখানিই ব্যক্তিগত, তবে প্রতিনিয়ত কাজ করলে আস্তে আস্তে সব কিছু ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিজে থেকেই আসবে। গোপালবাবুর ইঙ্গিত– ‘তবলায় গায়ের জোরে চাঁটি মেরে মেরে আঙুল ফাটাও, সেতারের তারে আঙুল ঘষে ঘষে রক্ত ঝরাও, গলা সাধো অনর্গল, নেচে নেচে পায়ের তলা ব্যথা করে ফেলো। তারপর নিজে থেকেই কখন আস্তে আস্তে কষ্ট কমে আসবে, ভাব আর ভাবনা বেড়ে যাবে।’ সত্যি কথা বলতে কী, এসব কথা কিন্তু গোপাল ঘোষ এমন ভাষায় বলেননি। ওঁর সান্নিধ্যই এসব বলেছে আমাকে।
সিনিয়র এক দাদার কাছে শুনেছিলাম, ভাব-ভাবনা আর অনুভূতির আর এক গল্প। সকাল সকাল ঝকঝকে রোদে এক ছাত্র আমাদের কলেজের বাগানে আঁকছে। ডালিয়া ফুলের গাছগুলোর ধারে বড় নাগকেশর গাছটার কড়া ছায়া পড়েছে ঘাসের মাঠে। রোদের তেজে ঘাসের সবুজ জ্বলজ্বল করছে। সেটাই এঁকেছে সে জলরঙে। কাজটা ঠিকমতো হয়নি, আলো-ছায়াগুলো যথাযথ নয়। যাই হোক, গোপালবাবুকে সেই ছবি দেখাল ছাত্র। মাস্টারমশাই খানিকক্ষণ ছবিটার দিকে আর খানিকক্ষণ ছাত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। পরে বলেছিলেন, একটা কাজ করো, তুমি জামাটা খুলে খালি গায়ে ওই ডালিয়া বাগানে ঘাসের মাঠে চড়া রোদ্দুরে বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকো। তারপরে তুমি ওই ছবিটা আবার আঁকো। এরপরে আর কিছু বলার বাকি থাকে না। ওঁর নিজস্ব ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন, এই ছবিটাতে কীসের অভাব।
ক্লাসরুমে বসে উনি ছবি আঁকা শেখাতেন যতটা, তার চেয়ে বেশি গল্প করতেন। সে সমস্ত গল্প চমৎকার আর খুব সরল। কথাপ্রসঙ্গে সেদিন মাস্টারমশাই ওঁর হাসপাতালে থাকার গল্প শোনাচ্ছিলেন। উনি একসময় বেশ কিছুদিন মানসিক অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতালে বায়না ধরলেন, আমার এখানে স্কেচখাতা চাই। স্কেচখাতা দেওয়া হয়েছিল। বেডে বসে বসে অন্যান্য রোগীদের আচার-আচরণ, তাঁদের ওঠাবসা ছবিতে আঁকতেন। এছাড়া নার্স, ডাক্তাররা যখন কাজ করতেন, তাঁদের চলাফেরা, কাজ কর্মের ধরন, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ওখানে যা দেখতেন তাই স্কেচ করতেন। মাঝে মাঝে মাথায় ভূত চাপত। উনি পাহারাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে চলে যেতেন। পিজি হাসপাতাল থেকে একবার উনি গভীর রাতে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন রেসকোর্সের দিকে। রাস্তায় বেরিয়ে গেটম্যান ঘুমোচ্ছে সেটাও স্কেচ করেছিলেন।
সেই সময়ের গল্প শুনে আমরা বায়না ধরলাম, একদিন দেখান না মাস্টারমশাই সেই হাসপাতালের স্কেচখাতা। উনি সত্যি সত্যি একদিন এনেছিলেন। সেই স্কেচখাতা থেকে ছবি দেখালেন, ছবির গল্প শোনালেন। যেটা সবচেয়ে অবাক হওয়ার, সেটা হল, সমস্ত ছবির নীচে সই করেছেন– ‘পাগল ঘোষ’।
অনেকবার অনুরোধ করলে উনি এক-আধবার এঁকে দেখাতেন। একবার উনি আমাদের ক্লাসে এঁকে দেখাচ্ছিলেন। কীভাবে আঁকলেন, বলার চেষ্টা করছি। প্রথমে ড্রইং বোর্ডে হ্যান্ডমেড পেপার আটকে সেটাতে আঁকবেন বলে টেবিলের ওপরে সাজালেন। তারপরে বোর্ডটাকে স্ল্যান্ট মানে একটু কাত করে টেবিলের ওপরে রাখলেন কোনও একটা বই কিংবা পেপারওয়েটে ঠেকা দিয়ে। প্রথমে কাগজটার ওপরে শুধুমাত্র জল বুলিয়ে দিলেন ফ্ল্যাট ব্রাশ দিয়ে। তারপর খানিকক্ষণ বসে রইলেন। এরপরে ওই জলটার কিছুটা কাগজ টেনে নিয়ে যখন নরম হল, তখন উনি সোজা দাঁড়িয়ে ওই কাগজটার ওপরে অনেকক্ষণ ধরে হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে নানারকম মাপজোক করছিলেন। এরপরে প্যালেটে কিছু কিছু রং নিয়ে সেগুলোতে জল দিয়ে মিশিয়ে তৈরি করলেন একটা ঘোলাটে নীল রং। ফ্ল্যাট ব্রাশে কাগজের ওপরের দিকে হালকা করে রাখলেন কিছুটা আকাশের মতো রং। ভিজে কাগজের ওপরে চুঁইয়ে ছড়িয়ে গেল খানিকটা। উনি চেয়ারে গিয়ে বসে রইলেন।
কাগজের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন গোপালবাবু। তারপরে বিদ্যুৎগতিতে দ্রুত ব্রাশ চালিয়ে উনি আঁকলেন একটি গাছ এবং দু’-একটা ডালপালা, কাগজের মাঝখান থেকে একটু বাঁদিকে। ততোধিক দ্রুততায় আঁকলেন একটি কালো রঙের পাখি, যার মুন্ডুটা গলার কাছে কুঁচকে এনে, এক্ষুনি যেন লাফিয়ে ডানা মেলে টেক অফ করবে। আরও একটা পাখি কাছাকাছি ডালে থেবড়ে বসে আছে নিশ্চিন্তে। আমরা দু’-শালিখ দেখলাম। বেশ কিছুক্ষণ বসার পরে আবার ছবির কাছে ফিরে এলেন মাস্টারমশাই। এক মনে তাকিয়ে রইলেন। আবার হাতে নিলেন তুলি, কিন্তু এবার কিছু আঁকলেন না। ছবির ডানদিকে নীচে সই করে দিলেন।
আমরা তখন নতুন, দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তাই এইরকম ভাবে ছবি আঁকাটা জীবনে প্রথম দেখলাম। গাছের বাকলের টেক্সচার নেই, আকাশ মেঘের আকার নেই, নীচে জমি নেই, গাছটাও ভাসমান। দু’-একটা লাইনের ডালপালা। একটা ম্যাজিকের মতো মনে হল। কত কিছুই আছে। সাদা কাগজখানা এখন শুধু কাগজ নয়, সেখানে যেন হাওয়া আছে। বসে থাকা পাখিটির ঘাড়ের পালকের গায়ে হাওয়া লাগছে, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম।
কলেজ শেষ। তবে ছাড়ার পরেও মাঝে মাঝে কোনও প্রদর্শনীতে, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ, আর্ট ফেয়ারে, দেখা হয়ে যেত গোপালবাবুর সঙ্গে। একা একা ঠিক চলতে পারতেন না; কিংবা বাড়ি থেকে একটু যত্ন নেওয়ার জন্য সঙ্গে ওঁর মেয়ে থাকত। মনে পড়ছে, কলকাতা আর্ট ফেয়ারে ঘাসের মাঠে বসে আছেন। হাতে সব সময় জ্বলন্ত সিগারেট। একটা সিগারেট শেষ হলে তারই আগুনে আর একটা সিগারেট ধরাতেন। ‘মাস্টারমশাই, আপনি খুব বেশি সিগারেট খাচ্ছেন’, আমরা বলতাম। উনি কথা ঘোরানোর জন্য বলতেন, ‘খুব ভালো ভালো ছবি আঁকছি আজকাল, জানো? অনেক কাজ হচ্ছে, খুব ভালো কাজ।’ হয়তো বললেন, ‘কাল একটা দারুণ ছবি এঁকেছি’। বলে হাতে রোল করা ছবির কাগজটা খুলে দেখালেন। পরে আস্তে করে বললেন, ‘পঁচিশটা টাকা দাও আর ছবিটা রেখে দাও’। খুব সাধারণের মতো অথচ অসাধারণ, এক আত্মভোলা মানুষ।
শান্তিনিকেতনে শুনেছি রামকিঙ্কর বেইজকে, বিনোদবিহারীকে ‘কিঙ্করদা’, ‘বিনোদদা’ বলতেন অনেকে। কিন্তু নন্দলাল বসুকে ‘নন্দদা’ বলতে কাউকে শুনিনি। উনি ছিলেন মাস্টারমশাই। ঠিক তেমনি কলকাতায় আমাদের কলেজে গোপাল ঘোষকে আমরা সবাই ‘মাস্টারমশাই’ বলেছি। এমনকী, আমাদের গুরু যাঁরা, তাঁরাও, যোগেন চৌধুরী, শ্যামল দত্তরায়, গণেশ হালুই নাকি তাঁদের কলেজ-জীবনে গোপালবাবুকে মাস্টারমশাই হিসেবেই পেয়েছেন। কেন সবাই গোপাল ঘোষকে প্রকৃত মাস্টারমশাই ভাবতেন? কী শেখাতেন?
মানুষের আচার-আচরণ, ব্যবহার এবং তার কাজের দিকটাই হয়তো শিক্ষার উপাদান। মাস্টারমশাইয়ের মধ্যে সেটাই ছিল। ভীষণ কম কথা। খুব দরকার হলে কাজটা করে দেখাতেন। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’। আবার ‘যা বলি তাই করো, যা করি তা করো না’, তাও তো আছে। এই দুটোই কিন্তু পেয়েছি মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে।
গোপাল ঘোষের জীবনের নেপথ্যের নৈঃশব্দ্য যত জেনেছি ততই অভিভূত হয়েছি পরবর্তীতে। পিতা ছিলেন মিলিটারি ক্যাপ্টেন। তাঁর চাকরির সুবাদে ছোটবেলা কেটেছে সিমলায়। পিতা বদলি হয়েছেন নানা জায়গায়, সেই সূত্রে দেখা হয়েছে অনেক কিছু, তৈরি হয়েছে চোখ, মন আর অনুসন্ধিৎসা। সাইকেলে ঘুরে ঘুরে সারা দেশ দেখেছিলেন। নিজেই নিজের নাম দিয়েছেন, ‘ভারতীয় ভবঘুরে’। ভারতের পরিব্রাজক। পরে ইউরোপ, আমেরিকাতেও ঘুরেছেন। দু’চোখ ভরে দেখতেন, উপভোগ করতেন। যা কিছু রহস্য যা কিছু রূপ, যা কিছু আকার, যা কিছু প্রকৃতি, ঘটনা বা দুর্ঘটনা সবই যেন উনি ধরে রাখতেন ওঁর মনের খাতায়।
আঁকার পাতায় আমরা যা পাচ্ছি, সেগুলোকে বলেছি ‘গোপাল ঘোষ ঘরানা’-র কাজ। কিন্তু কোন ঘরানার ছবি আঁকতেন গোপাল ঘোষ? অভিব্যক্তিবাদী? আসলে উনি কোনও ঘরানা বা শৈলীতে বিশ্বাসী হয়ে, বাধ্যবাধকতার সঙ্গে কাজ করতেন না। না পাশ্চাত্যের রূপ, না প্রাচ্য। তবে তুলির আঁচড়ে ছিল চাইনিজ টান আর ছবির ওজনে ইউরোপ। আকাঙ্ক্ষিত রূপটি পাওয়ার জন্য উনি কখনও শুদ্ধতা বজায় রাখতে চেষ্টা করেননি। জলরঙে উনি কাজ করতেন মানে এই নয় যে একেবারে আইন মেনে চলতে হবে। সাদা মিশিয়ে, অন্য মাধ্যমের সঙ্গে মিশ্র মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যেভাবে খুশি ওঁর চাহিদা মেটাতে চাইতেন। গোপাল ঘোষ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজও আধুনিক।
শিল্প আন্দোলনের কথাই যদি বলতে হয় তাহলে উনি ক্যালকাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। সমমনস্ক আটজন শিল্পীকে নিয়ে ১৯৪৩ সালে তৈরি হয়েছিল ক্যালকাটা গ্রুপ। ৪৩ সাল, তাই মন্বন্তরের সময়। বাংলায় দুর্ভিক্ষের আংশিক প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর শিল্পকর্মেও। আজও তিনি আধুনিক ভারতের একজন অসাধারণ নিসর্গ-চিত্রশিল্পী হিসেবে স্বীকৃত। নিজস্ব ভাষায় প্রকৃতির ব্যাখ্যা করার অশেষ ক্ষমতা তাঁর।
নিজের শিক্ষাগত দিকটাও স্বতন্ত্র। তখনকার দিনের মাদ্রাজ স্কুল অফ আর্টে শিখতে গেলেন। অদ্ভুতভাবে লক্ষ্যণীয় তখন ওখানে অধ্যক্ষ ছিলেন দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। দু’জনেরই একটা জায়গায় অদ্ভুত মিল। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী মূলত ভাস্কর। ভাস্কর্যের জন্যই তিনি বিখ্যাত অথচ জলরঙে উনি ছবি আঁকতেন চমৎকার। গোপালবাবুও তেমনি জলরঙের জন্যই বিখ্যাত, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে ভাস্কর্য শিক্ষা করেছেন। মাদ্রাজে দেবীপ্রসাদের সান্নিধ্যে এবং জয়পুর আর্ট স্কুলে– দু‘জায়গায় উনি ভাস্কর্য শিক্ষা করেছিলেন। এছাড়া মাঝে উনি স্থাপত্য নিয়েও পড়াতেন শিবপুরে, বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। তার মানে সেই শিক্ষাও তাঁর ছিল। সেকারণেই বোধহয় ওঁর ছবি ভাসাভাসা নয়, এত শক্ত-পোক্ত।
এই যে আমি জীবনের সমস্ত সময়টাই সমর্পণ করলাম জলরঙে, সে ইচ্ছের বীজ তো গোপাল ঘোষ। সান্নিধ্য কাকে বলে ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠি, পিছনে তাকাই বারবার। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, রবীন্দ্রনাথ, দেবীপ্রসাদের মতো মহান ব্যক্তিদের পুঞ্জীভূত আশীর্বাদ-ধন্য গোপাল ঘোষ আমার আরাধ্য। আমার মনে এক বিশেষ আসনে তাঁর স্থান। শুধু তাঁর সান্নিধ্য আর সংস্পর্শই আমাকে চালিত করেছে। আমি তাঁর পা ছুঁয়েই প্রণাম করেছিলাম।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ৩৮। প্রীতীশদা শিখিয়েছিলেন বন্ধুত্বের নতুন সংজ্ঞা– ‘ডোন্ট নক, জাস্ট কাম ইন’
পর্ব ৩৭। সুনীল দাসের ছবি আঁকা ছিল কাগজে পেনসিল না ঠেকিয়ে একটু ওপরে, যেন হাওয়াতে ড্রইং হচ্ছে
পর্ব ৩৬। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমারের বাংলার হরফ সংস্কারের কাজই সত্যজিৎকে টাইপোগ্রাফি চর্চার দিকে ঠেলে দিয়েছিল
পর্ব ৩৫। যদি সত্যিই কোনও কিছুকে ভালোবাসো, তবে সাহসী হও– বলেছিলেন ড. মুকেশ বাত্রা
পর্ব ৩৪। শক্তিদার ব্র্যান্ড কী? উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বাংলায় কোনও ব্র্যান্ড হয় না’
পর্ব ৩৩। পত্রিকা পড়তে ছোটদের যেন কোনও অসুবিধে না হয়, খেয়াল রাখতেন নীরেনদা
পর্ব ৩২ । কে সি দাশের ফাঁকা দেওয়ালে আর্ট গ্যালারির প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বীরেনদা
পর্ব ৩১। কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে, আমার জন্য তেজপাতা আর পাঁচফোড়ন নিয়ে এসেছিলেন অহিদা
পর্ব ৩০। হাতের লেখা ছোঁয়ার জন্য আপনার ছিল ‘ভানুদাদা’, আমাদের একজন ‘রাণুদিদি’ তো থাকতেই পারত
পর্ব ২৯। পুবের কেউ এসে পশ্চিমের কাউকে আবিষ্কার করবে– এটা ঢাক পিটিয়ে বলা দরকার
পর্ব ২৮। অন্ধকার নয়, আলো আঁকতেন গণেশ পাইন
পর্ব ২৭। প্রীতীশ নন্দীর চেয়েও কলকাতা ঢের বেশি চেনা অমিতাভের!
পর্ব ২৬। রুদ্রদা, আপনার সমগ্র জীবনযাত্রাটাই একটা নাটক, না কি নাটকই জীবন?
পর্ব ২৫। ক্ষুদ্রকে বিশাল করে তোলাই যে আসলে শিল্প, শিখিয়েছিলেন তাপস সেন
পর্ব ২৪: নিজের মুখের ছবি ভালোবাসেন বলে জলরঙে প্রতিলিপি করিয়েছিলেন মেনকা গান্ধী
পর্ব ২৩: ড. সরোজ ঘোষ আমাকে শাস্তি দিতে চাইলেও আমাকে ছাড়তে চাইতেন না কখনও
পর্ব ২২: মধ্যবিত্ত সমাজে ঈশ্বরকে মানুষ রূপে দেখেছেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ২১: ‘তারে জমিন পর’-এর সময় আমির খান শিল্পীর আচার-আচরণ বুঝতেই আমাকে ওঁর বাড়িতে রেখেছিলেন
পর্ব ২০: আমার জলরঙের গুরু শ্যামল দত্ত রায়ের থেকে শিখেছি ছবির আবহ নির্মাণ
পর্ব ১৯: দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরতেন জয়াদি, না, কোনও স্টাইলের জন্য নয়
পর্ব ১৮: সিদ্ধার্থ যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা-জগতের কবি
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল