Robbar

দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে মা দৌড়ে বেরিয়ে গেল, ইবতিসম্‌-এর উপন্যাসের শুরু এমনই আকস্মিক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 2, 2025 9:18 pm
  • Updated:June 4, 2025 4:16 pm  

দিদিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত নাতনি আলা খুঁজে পাচ্ছে দিদিমাকে সমুদ্রের তীরে, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চুপ করে বসে আছে। বাচ্চা মেয়ে। সে বুঝতে পারে দিদিমা ওই ভাবে বসে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মরে গেছে! কিন্তু সে কাঁদে না। দিদিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে তো। যদিও দিদিমা অনেকক্ষণ আগে মরে গেছে। তবুও। তারপর, অনেক বছর পরে, নিউ ইয়র্কে লাল নোটবুক কিনে আলা যখন লিখতে বসে তার দিদিমার মৃত্যুর কথা, আর ভেবে পায় না কী লিখবে, লেখার টেবিলের গায়ে ফুটে ওঠে এই ছোট্ট বিপুল বাক্য: সমুদ্রে অত জল, আমার চোখে এক ফোঁটা জল নেই!

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

৪৩.

এই প্রথম! এই প্রথম! এবং এই প্রথম!

আমি আরবি ভাষায় লেখা একেবারে এই সময়ের একটি উপন্যাস ও তার লেখিকার কথা লিখছি। এবং লিখছি উপন্যাসটি পড়ে আচ্ছন্ন মুগ্ধতায়। লেখিকা ইবতিসম্ আজেম। ইনি প্যালেস্তিনীয়। লেখেন আরবিতে। উপন্যাসের নাম ‘The Book of Disappearance’। এটি ইবতিসম্-এর দ্বিতীয় উপন্যাস। এবং এই উপন্যাস এই বছর আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজের জন্য শর্ট লিস্টেড হয়েছিল। তবে বুকার পেলেন কর্নাটকের লেখিকা বানু মুশতাক।

Buy The Book Of Disappearance Book Online at Low Prices in India | The Book Of Disappearance Reviews & Ratings - Amazon.in

বানুকে নিয়ে ইতিমধ্যেই লিখেছি কাঠখোদাই কলামে। আমার কী সৌভাগ্য, বানুর এবং ইবতিসম্– দু’জনের উপন্যাস পাশাপাশি পড়তে পেরেছি। ইবতিসমের আরবি ভাষায় লেখা উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ইরাকের কবি, ঔপন্যাসিক, স্কলার, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সিনান আনতুন। প্রকাশক– সিমন অ্যান্ড স্কুস্তের। কলকাতার বইবাজারে এই কিতাব লেটেস্ট গরম হওয়া।

এই সুন্দরী আরবি লেখিকার সঙ্গে বাঙালির এই প্রথম পরিচয়। রহস্যময়ী। বিশেষ কিছু তাঁর সম্বন্ধে জানা যায় না। এমনকী, বইয়ের লেখক পরিচিতিতেও তেমন কিছু নেই! এই কার্পণ্য আমাকে অবাক করেছে। যেটুকু জেনেছি, সেটুকু এই:
ইবতিসম্ প্যালেস্তিনীয়। জন্মেছেন জাফার কাছে। কোন বছরে জন্ম, হদিশ পাইনি। তবে একাধিক ছবি দেখে মনে হয়েছে তিনি দারুণ দহনের মধ্য তিরিশে। শরীর দিয়ে গড়িয়ে নামছে মস্তিষ্কের দীপন! এবং তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসের ভাষা, বিষয়, বিন্যাস ধারণ করছে এই বিভা। উপন্যাসটা একজনের ডায়েরি। আর একজন পড়ছে, বুঝছে, ব্যাখ্যা করছে। পড়তে পড়তে বোঝা যায়, কেন লেখিকা রচনা করেছেন আড়াল। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে প্যালেস্তাইনে, আরবদের অনিশ্চয়তার মধ্যে, প্রতিদিনের বিপদের মধ্যে। পারিবারিক নিশ্চয়তা তিনি পাননি। তাঁর দিদিমা ১০ বছর নির্বাসিত ছিলেন কাঁটাতারের মধ্যে বেরুটে। তাঁর মা কোনও দিন নিজের জীবনে পাননি একদিনের জন্যেও স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ। এবং তিনি লেখিকা নিজে পালিয়ে বাঁচেন জার্মানিতে। তাঁর মাতৃভাষা আরবি। তিনি এখন থাকেন নিউ ইয়র্কে। তাঁর পেশা সাংবাদিকতা। তাঁর প্রথম উপন্যাস– ‘The Sleep Thief’, ঘুম চোর, বেরিয়ে ছিল ২০১১-তে। পড়িনি।

Ibtisam Azem — Center for Palestine Studies | Columbia University
ইবতিসম্ আজেম

এবার আসছি ইবতিসম্-এর উপন্যাসে যে বই এই মাত্র শেষ করলাম। এবং আমার মনের প্রথম প্রশ্নটি হল, এই লেখিকার লেখার টেবিলটি কি তার মধ্যে বহন করছে লেখিকার প্রথম জীবনের সমস্ত সর্বনাশ, ভীতি, বিপন্নতা, দিশাহারা আঁধার? না হলে উপন্যাসের প্রথম লাইন কি হতে পারে:
আমার মা এইমাত্র দৌড়ে বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল, দু’-পায়ে দু’-রকমের জুতো! ‘My mother put on mismatched shoes and ran out of the house.’ মাস্টারস্ট্রোক! জাস্ট একটা লাইন। সুপার্ব শুরু! বোঝা যাচ্ছে কী অস্থির অবস্থা! দিদিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত নাতনি আলা (এই উপন্যাসের লেখিকা, ধরে নিতেই হবে, নিতান্ত বালিকা তখন) খুঁজে পাচ্ছে দিদিমাকে সমুদ্রের তীরে, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চুপ করে বসে আছে। বাচ্চা মেয়ে। একটু একটু করে সে বুঝতে পারে দিদিমা ওই ভাবে বসে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মরে গেছে! কিন্তু সে কাঁদে না। দিদিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে তো। যদিও দিদিমা অনেকক্ষণ আগে মরে গেছে। তবু তো অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। তারপর, অনেক বছর পরে, নিউ ইয়র্কে লাল নোটবুক কিনে আলা যখন লিখতে বসে তার দিদিমার মৃত্যুর কথা, আর ভেবে পায় না কী লিখবে, লেখার টেবিলের গায়ে ফুটে ওঠে এই ছোট্ট বিপুল বাক্য: সমুদ্রে অত জল, আমার চোখে এক ফোঁটা জল নেই!

[The cover of Ibtisam Azem`s Sariq al-Nawm (The Sleep Thief). Image by Dar al-Jamal]
‘দ্য স্লিপ থিফ’-এর আরবি সংস্করণ

ওই নোটবুক আলার গল্প। পড়ছে তার বন্ধু এরিয়েল। কীভাবে প্যালেস্তিনিয়ান আরবদের নিজেদের দেশ থেকে নির্বাসনে পাঠান হল, তারপর ভ্যানিশ করে দেওয়া হল তাদের, আলা রেখে গেছে সেই নোটবুক। এবং এই উপন্যাস সেই ঐতিহাসিক উবে যাওয়ার নোটবুক:
নিউ ইয়র্ক থেকে আলা তার দিদিমাকে লিখছে– তুমি কি জান কেন তোমাকে সব থেকে, সবার থেকে বেশি ভালবাসি? কেননা, তুমি ভালবেসেছিলে জীবন। এবং কখনও হারাওনি আশা। তারপর তুমি ভালোবাসতে শিখে ছিলে জাফাকে। সবাই চলে গেল জাফা ছেড়ে। তুমি গেলে না। ‘ইউ ওয়ার আলন ইন জাফা’। তোমার কাছ থেকে আমিও শিখেছিলাম জাফাকে ভালবাসতে। নিউ ইয়র্কে দিদিমা আমি তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, আরবি ভাষায় তোমার আর্ত কথা, ওগো আমার জাফা ,কী আশ্চর্য সুন্দর তুমি, প্যালেস্তাইন, তুমি কী সুন্দর!

এমন লেখা কি শুধু নির্বাসনে লেখা যায়? পাওয়া যায় এমন লেখার টেবিল শুধুমাত্র নির্বাসনে?

 

…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব  ……………………

পর্ব ৪২: অন্ধকার ভারতে যে সিঁড়িটেবিলের সান্নিধ্যে রামমোহন রায় মুক্তিসূর্য দেখেছিলেন

পর্ব ৪১: বানু মুশতাকের টেবিল ল্যাম্পটির আলো পড়েছে মুসলমান মেয়েদের একাকিত্বের হৃদয়ে

পর্ব ৪০: গোয়েটের ভালোবাসার চিঠিই বাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের সুইসাইড প্রবণতা

পর্ব ৩৯: লেখার টেবিল বাঙালির লাজ ভেঙে পর্নোগ্রাফিও লিখিয়েছে

পর্ব ৩৮: বঙ্গীয় সমাজে বোভেয়ার ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর ভাবনার বিচ্ছুরণ কতটুকু?

পর্ব ৩৭: ভক্তদের স্তাবকতাই পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র-কীর্তি স্থায়ী হতে দেয়নি, মনে করতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী

পর্ব ৩৬: একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে মারিও ভার্গাস লোসা যেন ছবি বিশ্বাস!

পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি

পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল

পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা

পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই

পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না

পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা

পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ

পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?

পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!

পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল

পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো

পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়

পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!

পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে

পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে

পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি

পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল

পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল

পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল

পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে

পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে

পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা

পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল

পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে

পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?

পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব

পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি

পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল

পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি

পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে

পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল

পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা

পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা

পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে

পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল