রবীন্দ্র-পূজারীদের কি চোখে দেখেছেন নীরদচন্দ্র? তিনি জানাচ্ছেন, ‘তাঁদের আমি রবীন্দ্রনাথের মোসাহেব বলতে পারি।’ কেন মোসাহেব? নীরদবাবুর অকাট্য যুক্তি ও অমোঘ পাণ্ডিত্যের বেত্রাঘাত: বাঙালি ধনী ব্যক্তির একদল মোসাহেব থাকে। বাংলা ভাষাতে মোসাহেব শব্দটা চাটুকার অর্থে ব্যবহৃত। শব্দটা ফারসি। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আরবি ভাষায় যেখানেই ‘মু’, ফারসিতে ‘মো’ প্রত্যয় (Prefix) আছে, তার অর্থ, ‘যুক্ত থাকা’। যেমন, যে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত সে মুসলিম, যে প্রশংসার সঙ্গে যুক্ত সে মুহম্মদ, যে বারিকের অর্থাৎ সৌভাগ্যের সঙ্গে যুক্ত সে মুবারক। তেমনই, যে বা যারা সাহেবের সঙ্গে যুক্ত, সে বা তারা মোসাহেব। এই সাহেবটি যে রবীন্দ্রনাথ, সে বিষয়ে সন্দেহের জায়গা নেই।
৩৭.
এবারের কাঠখোদাই লিখতে যেই বসেছি, টেবিলটা আমার দিকে পরিষ্কার তাকিয়ে চোখ মারল। আর আমার মনে পড়ে গেল, এই বছর তাঁর মৃত্যুর বয়েস ৮৪ হল। এবং সামনেই তাঁর জন্মদিন। ২৫ বৈশাখের কথা মনে এলেই মনে আসে রবীন্দ্রনাথের ভক্তদের। আর রবীন্দ্র-ভক্তদের মনে পড়লেই বিলেতে অক্সফোর্ড শহরে একটি ছোট্ট বাড়িতে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বেপরোয়া লেখার টেবিলের কথা মনে পড়ে যায়। যে টেবিলে বসে রবীন্দ্রনাথের ভক্তদের নিয়ে নীরদচন্দ্র একদা লিখলেন, এঁরা রবীন্দ্রনাথের চারিদিকে ময়রার দোকানে সাজানো সন্দেশের চারিদিকে মাছির মতো ভনভন করতেন।
এইবার আমার লেখার টেবিল আমাকে নির্দেশ দিল, তুই নীরদের ‘করতেন’ কেটে ‘করেন’ লিখে দে। আমি টেবিলের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। নীরদচন্দ্রের ওপর কলম চালালাম। এবং বাক্যটির দিকে তাকালাম। বাক্যটিকে বেশ জোরালো ও যুতসই লাগল।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী এই উক্তিটা করেছেন তাঁর ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে।
এই বইয়ে নীরদবাবু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রভক্তের দল রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে তাঁর কত বড় সর্বনাশ করেছিল! এবং মৃত্যুর পরেও তাঁকে রেহাই দেয়নি। রবীন্দ্র-পূজারিদের প্রসঙ্গে নীরদচন্দ্রের চিমটি চমকপ্রদ: ‘রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্বন্ধে তাঁদের গভীর জ্ঞান আছে কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।’ রবীন্দ্রভক্তদের বোধ বা উপলব্ধি সম্বন্ধে নীরদবাবুর আরও বেশি সংশয়।
তাহলে রবীন্দ্র-পূজারিদের কী চোখে দেখেছেন নীরদচন্দ্র? তিনি জানাচ্ছেন, ‘তাঁদের আমি রবীন্দ্রনাথের মোসাহেব বলতে পারি।’ কেন মোসাহেব? নীরদবাবুর অকাট্য যুক্তি ও অমোঘ পাণ্ডিত্যের বেত্রাঘাত:
বাঙালি ধনী ব্যক্তির একদল মোসাহেব থাকে। বাংলা ভাষাতে মোসাহেব শব্দটা চাটুকার অর্থে ব্যবহৃত। শব্দটা ফারসি। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আরবি ভাষায় যেখানেই ‘মু’, ফারসিতে ‘মো’ প্রত্যয় (Prefix) আছে, তার অর্থ, ‘যুক্ত থাকা’। যেমন, যে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত সে মুসলিম, যে প্রশংসার সঙ্গে যুক্ত সে মুহম্মদ, যে বারিকের অর্থাৎ সৌভাগ্যের সঙ্গে যুক্ত সে মুবারক। তেমনই, যে বা যারা সাহেবের সঙ্গে যুক্ত, সে বা তারা মোসাহেব। এই সাহেবটি যে রবীন্দ্রনাথ, সে বিষয়ে সন্দেহের জায়গা নেই। এই সাহেবের মোসাহেবরা সর্বদাই সাহেবের যে কোনও কথার উত্তরে ‘হ্যাঁ জি’, ‘হ্যাঁ জি’ করতে থাকেন। প্রতি পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণ সেই ‘হ্যাঁ জি’, ‘হ্যাঁ জি’-র নানা রূপের বর্ণিল বর্ষণে আজও ভিজে চলেছে। কিন্তু এই ভক্তদের দ্বারা রবীন্দ্রনাথের কোনও উপকার হয়নি, জানাচ্ছেন নীরদচন্দ্র।
‘রবীন্দ্রনাথের উপর যে-সব আক্রমণ হইত, তাহার কোনো উত্তর তাঁহারা (ভক্তরা) দিয়াছেন বলিয়া আমি পড়ি নাই। অবশ্য রবীন্দ্রবিদ্বেষীদের মতো তাঁহাদেরও বিচারহীন গোঁড়ামি ছিল। কিন্তু তাঁহারা প্রতিপক্ষের সহিত যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হইতেন না, বরঞ্চ এইসব গালিগালাজ শুনিলে ছোট শিশুরা যেমন কাঁদিয়া মায়ের কাছে যায় তেমনি রবীন্দ্রনাথের কাছেই গিয়া উপস্থিত হইতেন। কেহ তাঁহাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছে, তাহার উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ কখনও করেন নাই।’
রবীন্দ্রনাথকে যে ব্রাহ্মভক্তরা একসময় আরও স্পেশাল চোখে দেখত, তাদের এক হাত নিতে ছাড়েননি নীরদচন্দ্র:
ব্রাহ্ম যুবকেরা রবীন্দ্রনাথকে ব্রাহ্মদের কবি বলেই মনে করত। তারা বিদেশে গেলে দেশে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মিথ্যা বলতে ইতস্তত করত না। এদের মুখে রবীন্দ্র স্তব ও স্তুতি শুনতে শুনতে আইরিশ কবি ইয়েটস একদিন বলেই ফেললেন, এই রকম যুক্তিহীন গদগদ ভক্তি ইংল্যান্ডে মধ্যযুগে চ্সারের সময়ে ছিল। বাঙালির মধ্যে আজও আছে?
এইবার সরাসরি চলুন নীরদচন্দ্র চৌধুরীর সেই বেপরোয়া লেখার টেবিলের কাছে। সেই টেবিলে বসেই নীরদবাবু লিখেছেন, এই সব ভক্তর স্তাবকতাই পাশ্চাত্য দেশে রবীন্দ্রনাথের কীর্তি স্থায়ী হতে দেয়নি। বিলেতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে ইংরেজের উদাসীনতা দেখে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তবুও রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভক্তদের উৎপীড়ন সম্বন্ধে একান্ত সহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন। কেন? এই ব্যাপারটা আমি একেবারেই বুঝতে পারিনি।
……………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………
প্রশ্ন হল, রবীন্দ্রনাথের আসল রূপটা তাহলে কী? জানাচ্ছেন নীরদবাবু, ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে আমি রবীন্দ্রনাথের সত্য রূপ বোঝার চেষ্টা করেছি। তাঁর সম্পর্কে সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা আজ পর্যন্ত হয়নি। আমি সারা জীবন সেই রূপটি ধরবার চেষ্টা করেছি। মনে হয় অবশেষে হয়তো ধরতেও পেরেছি। তবে আমার ধারণায় তাঁর যে রূপ এসেছে সেটা দ্বিধাবিভক্ত। এক দিক আত্মসমাহিত রবীন্দ্রনাথের। অন্যদিক আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথের।
আসন্ন ২৫ বৈশাখে রবীন্দ্র-পূজারিরা যেন রবীন্দ্রনাথের এই দুই পরস্পর-বিরোধী রূপকেই মনে রাখেন!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৩৬: একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে মারিও ভার্গাস লোসা যেন ছবি বিশ্বাস!
পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি
পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল
কিন্তু কেন আমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলাম? কেন তাকে পিটিয়ে মারার আগে খেতে দিলাম? কী জানি, একেক সময় মনে হয়, পথের ধারে যে মাংসর দোকানের সামনে দিয়ে আমরা যাতায়াত করি আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, সেখানেও কাটার আগে পাঁঠাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দেওয়া হয়।
প্রীতীশদা বলতেন, আমি এই ‘লাভ’ (love) শব্দটাকে একেবারে পছন্দ করি না। আই লাইক ‘হেট’ অর ‘রেসপেক্ট’– এখন বুঝি, এটা বজায় রাখার জন্যই প্রীতীশদার এত পাগলামি! ‘এক্সট্রিমিস্ট’ যাকে বলে আর কী! ওঁর বিশ্বাস, পৃথিবী কালকেই শেষ হয়ে যাবে, যা করার আজকেই করতে হবে এবং তা হবে জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ।
ছুটির দিনে তাই মৃণালিনী দেবী নিজের হাতে রেঁধে পুত্র-সহ আশ্রমের ছাত্রদের খাইয়ে তিনি পরিতৃপ্তি বোধ করতেন। শিক্ষাপ্রণালী ও পল্লি পুনর্গঠন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে চিন্তা তথা পরীক্ষানিরীক্ষার বিপুল জাহাজ বয়ে চলছিল, তার হাল যাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে ধরে বসেছিলেন– বলা যায়, তাঁদের প্রধান ছিলেন আশ্রমলক্ষ্মী প্রতিমা।