ঋতুদার ভীষণ পছন্দের জায়গা ছিল মর্গান হাউজ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পরবর্তীকালে তথ্যচিত্র বানানোর সময়, একটা শিডিউল ছিল লন্ডনে। সে সময় ঋতুদার শরীর ভাল যাচ্ছিল না। পুরো লন্ডনের সিকোয়েন্সটা করা হয় এই মর্গান হাউজে। ব্রিটিশ স্থাপত্য কী অপত্য স্নেহে আজও পরাধীন করে রেখেছে দিশি লোকেশনকে। ডিনার ঠিক কী হয়েছিল মনে নেই। কিন্তু মনে আছে, মিঠুনদার মুখ ঢাকা ছিল পুরো সময়টায়, যদি ফ্যানেদের উৎপাত শুরু হয় সেই ভয়ে।
২৫.
‘তিতলি’র শুটিংয়ে ভীষণ পছন্দের একটা টুপি হারিয়ে ফেলি। ‘ফ্লাইং মেশিন’ কোম্পানির মেরুন রঙের। পুরো শুটিং ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল টুপিটা। শিডিউলের শেষদিকে এসে খোয়াই। মনখারাপ হয়েছিল খুব। ঋতুদা লাঞ্চব্রেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে বল তো? প্রেম ভেঙে গেছে?’ বললাম। খুব একটা পাত্তা দিল না। অদ্ভুতভাবে হেসে বলল, “খুঁজলে ডিরেক্টর’স ক্যাপ খুঁজে দ্যাখ।” সেই পরিস্থিতিতে কথাটা শুনে খুবই তেতো লেগেছিল। এখন মনে হয়, খারাপ কিছু বলেনি। পার্থিব সামান্য কিছুর থেকে অজানা মুকুট অনেক গুণে বড় অ্যাডভেঞ্চার। সেই রাতে ঋতুদা ঘরে এসে একটা মুখে মাখার ক্রিম দিয়ে গেল। বলল, ‘তোরা তো নোংরার জাশু। এতদিন পাহাড়ে রয়েছিস, মুখে-চোখে সামান্য ক্রিমও লাগাস না।’ এই ঘটনাটা এখনও বুঝতে পারি না। সেদিনই কেন ঋতুদার ক্রিম দেওয়ার দরকার পড়ল? এ-ও কি এক ধরনের ইয়ার্কি? দুঃখে মলম লাগানোর ব্যবস্থা?
শুটিং স্পট খোঁজার জন্য আমরা রোজই লাভা থেকে বেরিয়ে রওনা দিতাম লোলেগাঁও-এর দিকে। ওই পথটুকু চোখের আরাম। ওই পথে একটা জায়গা পড়ত, নাম আলগারা। ওখান থেকে পুরো উপত্যকাটা দেখতে লাগত স্বপ্নের মতো। ‘তিতলি’র বহু স্মরণীয় আউটডোর ওই আলগারাতেই করা। ছবিটার একটা বড় শুটিং ছিল চলন্ত গাড়ির ভেতর। সেই শটগুলো এই এলাকাতেই নেওয়া। আবার গাড়ি দাঁড় করিয়ে যে নায়ক-নায়িকার অভিব্যক্তি– সব ওখানেই। খুব সুন্দর কিছুও রোজ দেখতে একঘেয়ে লাগে। মনে হয়, ধুর, আর কতবার আসব এই জায়গায়?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘লিটল মারমেড’ ছবির একটা গান ছিল– ‘কিস দ্য গার্ল’। সেই গানের ধরতাই শুরু হয় নানা জীবজন্তুর আওয়াজ জুড়ে। এখানে শুধু পাখিদের ডাক। কতরকম আর কত বিচিত্র সেই সিম্ফনি। পুরোটা মেঘের মধ্যে, তাই ভ্যালি দেখাও যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, মেঘলা এই আবছায়ার মধ্যে থেকে কেউ যেন বিচিত্রানুষ্ঠান বসিয়েছে। আমি যে অনেক দূরে বা শুটিং-এর যে আরও লোকজন আছে, এসব বেমালুম ভুলে গিয়েছি এই আজব সম্মোহনে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
হিসি করতে করতে আশপাশের পাথর, গাছের সঙ্গে হিসতুতো ভাইয়ের আত্মীয়তাও জন্মে গিয়েছে। পাহাড়ে শুটিংয়ের এই এক সুবিধে। যে কোনও প্রাকৃতিক ডাক ওই প্রকৃতির মধ্যেই রেখে আসা যায়। একটু বিকেলের দিকে আলগারায় মেঘ ঢুকে আসত। এই রোদ খটখট করছে, এই গলা অবধি মেঘে ডুবে গেলাম। এর’ম অভিজ্ঞতা এর আগে কখনও হয়নি! এমনই একদিনের শেষবেলার শুট। ক্যামেরা, ট্রলি, রিগ, চরিত্র, পরিচালক ভাসিয়ে মেঘ ঢুকে গেল কোথা থেকে। ঠিক সেই সময়টায় আমি একটু দূরে, ইউনিট থেকে ছন্নছাড়া। যে বিপুল পরিমাণে মেঘে ডোবা দশা, বুঝতে পারলাম আজকের মতো এখানেই ইতি। এমনিতে মিনিট ৫-১০ পর মেঘ সরে যায়। সেদিন কী খেলাচ্ছলে আরও বেশিক্ষণ ছিল। ইউনিটের টর্চের আলোর সাবধানবাণী পাত্তা না দিয়ে গোঁয়ারগোবিন্দ মেঘমহল দখল নিল গোধূলির। প্রথমটা একটু ভয় লাগছিল, তারপর এই ডুবে থাকাটা একটু একটু অভ্যেস হয়ে গেল। গোধূলি সন্ধির এক আশ্চর্য গীতিনাট্য শুরু হল এবার। প্রথমে একটা ডাক শুনছিলাম কাঠঠোকরা পাখির। তারপর একে একে বাকিরা যোগ দিতে শুরু করল। ‘লিটল মারমেড’ ছবির একটা গান ছিল– ‘কিস দ্য গার্ল’। সেই গানের ধরতাই শুরু হয় নানা জীবজন্তুর আওয়াজ জুড়ে। এখানে শুধু পাখিদের ডাক। কতরকম আর কত বিচিত্র সেই সিম্ফনি! পুরোটা মেঘের মধ্যে, তাই ভ্যালি দেখাও যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, মেঘলা এই আবছায়ার মধ্যে থেকে কেউ যেন বিচিত্রানুষ্ঠান বসিয়েছে। আমি যে অনেক দূরে বা শুটিংয়ের যে আরও লোকজন আছে, এসব বেমালুম ভুলে গিয়েছি এই আজব সম্মোহনে। যে অবাক শিস-মহল আমার মেঘে মেঘে সাজিয়ে তুলছিলাম, সেখানে একটাই গান মনে পড়ছিল– ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সঙ্গীত ভেসে আসে…’।
শুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়াতে একটা মজা হল, ঋতুদা সেদিন তাল তুলল, মর্গান হাউজে ডিনার খেতে যাবে। আমাদের দিকে চোখ টিপে বলল, ‘বোকার মতো এটা সবাইকে ঘোষণা করে দিও না, শুধু ডিরেক্টোরিয়াল টিম যাবে।’ সত্যি বলতে কী, মর্গান হাউজ যে কালিম্পং-এ, আমি সেটাও জানতাম না! একটা কোয়ালিস আর একটা টাটা সুমো রওনা দিল কালিম্পং অভিমুখে। কোয়ালিস-এ ঋতুদার সঙ্গে রয়েছেন মিঠুনদা, বোধহয় তাঁর ইচ্ছেতেই এই মহার্ঘ্য যাত্রা। সকলেরই মর্গান হাউজ নিয়ে হাজারো স্মৃতি, আমার ছাড়া। আর সকলেরই এক বক্তব্য– ওই বাড়িতে ভূত আছে। সারণ কমিউনিস্ট, ভগবান মানে না, এদিকে ভূতে ভয় পায়। পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকটাই রাত হয়েছিল। দুধসাদা বাংলোটা রাতের অন্ধকারে দেখে বেশ গা-ছমছম করছিল, সেকথা সত্যি। ঋতুদার ভীষণ পছন্দের জায়গা ছিল মর্গান হাউজ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পরবর্তীকালে তথ্যচিত্র বানানোর সময়, একটা শিডিউল ছিল লন্ডনে। সে সময় ঋতুদার শরীর ভাল যাচ্ছিল না। পুরো লন্ডনের সিকোয়েন্সটা করা হয় এই মর্গান হাউজে। ব্রিটিশ স্থাপত্য কী অপত্য স্নেহে আজও পরাধীন করে রেখেছে দিশি লোকেশনকে। ডিনার ঠিক কী হয়েছিল, মনে নেই। কিন্তু মনে আছে, মিঠুনদার মুখ ঢাকা ছিল পুরো সময়টায়, যদি ফ্যানেদের উৎপাত শুরু হয় সেই ভয়ে।
ফেরার রাস্তায় আমি বরাবরের মতো বসেছিলাম টাটা সুমোর পিছনে। কে জানে কোন ভূত সওয়ার হল, আমি প্রচণ্ড ঢুলতে শুরু করলাম। মাথা ঘুরছিল প্রবল, পাহাড়ে রাতে গাড়ি চালানো বেশ ঝক্কির, ওই আলোগুলো দেখতে দেখতে আমি যেন ডুবে যাচ্ছিলাম একরাশ মেঘের ভেতর, গাড়ি থেকে কখন নেমেছি, কখন ঘরে গিয়ে শুয়েছি, মনেও নেই। শুধু মনে আছে, পরদিন আলগারার ভ্যালির সামনে বিড়বিড় করে বলেছিলাম, আমার আর ভাল লাগছে না এখানে।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?