একদিন নিজে আমাকে একটি অসাধারণ কথা বললেন, সেটা হচ্ছে, তুমি অফিসে এসে আমার কেবিনের বাইরে রিসেপশন এরিয়াতে বসে থাকবে না। তুমি রিসেপশনের ছেলেমেয়েদের বন্ধু নও। আমি ভেতরে যেমন পরিস্থিতিতেই থাকি না কেন তুমি এসে সরাসরি দরজা ঠেলে আস্তে করে ঢুকে পড়বে। যদি ব্যস্ত থাকি ভিতরে বসে বই পড়বে কিন্তু বাইরে আর ওয়েট করবে না। এমনকী দরজা নক করারও দরকার নেই। তৈরি হল বন্ধুত্বের নতুন সংজ্ঞা– ‘ডোন্ট নক্, জাস্ট কাম ইন’। সে ছিল এক মস্ত অধিকার।
৩৮.
এ বছরের গোড়ায় প্রীতীশদা যেদিন চলে গেলেন তার পরের দিন লিখেছিলাম শোকসংবাদ, এইখানেই, রোববার ডিজিটালে। সেদিন বলেছিলাম ওঁর কর্মকাণ্ডের কথা, মেজাজ-মর্জির কথা, সংবাদ সংস্থার পরিচালনা-সম্পাদনার ক্ষমতার কথা। সে বিবরণ ছিল ফুরফুরে মেজাজে, হালকা চালে। কোনও শোক-দুঃখের অনুভূতির ছোঁয়া ছিল না। মনে হয়েছিল, এই তো ক’দিন আগেই কত কথা হল ফোনে। ওই খবরটা ছিল আমার কাছে অবিশ্বাস্য! আর অবিশ্বাসের ঝোঁকেই যা কিছু বলা।
‘মুখ ও মণ্ডল’ সিরিজে ‘প্রীতীশ নন্দী’ নামটা লিস্টে অনেক আগেই ছিল। অনেক বিষয় মিলিয়ে এই মানুষটির চরিত্র আমার কাছে ভীষণ, ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ওঁর চলে যাওয়ার পরে দু’বার লিখব না বলে বাদ দিয়ে রেখেছিলাম। বেশ কিছুদিনের ব্যবধানে আবার আজকে লিখতে বসে মনটা বড়ই ভারাক্রান্ত। একটা বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে মন জুড়ে। আজ বিশ্বাস হচ্ছে সত্যিকারের মানুষটা নেই। কত কথাই ওঁর সম্পর্কে বলার ছিল। মনে হচ্ছে, আজই বোধহয় সত্যিকারের শোকবার্তা লিখতে বসেছি।
প্রীতিশ নন্দী– এক নাম, কিন্তু বহুমাত্রিক তাঁর প্রতিভা। কবি, সাংবাদিক, সম্পাদক, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রপ্রেমী, রাজ্যসভার সাংসদ, সমাজসেবী এবং ব্যবসায়ী। লক্ষ্য করার মতো, তাঁর কর্মজীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন এক একটি ভিন্ন শিল্পধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই উপস্থিত তাঁর সাংবাদিক মানসিকতার গভীর ছাপ। তথ্য, বিশ্লেষণ, বাস্তবতা এবং মানবিকতার সংমিশ্রণে তিনি যে সাহিত্য ও শিল্প চর্চা করেছেন, তা আজও সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আমার সৌভাগ্য ওঁর কর্মজীবনের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছি এবং কোনও না কোনও কাজে অংশগ্রহণ করেছি।
বাঙালির ব্যবসা-বাণিজ্যের গল্প, অল্প-বিস্তর সবারই জানা। সেখানে বিশাল সফলতা যেমন আছে, আবার ন্যাজে-গোবরে হয়ে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার গল্পও আছে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর শিল্প-বাণিজ্যের উদ্যোক্তা ও সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মযোগীদের প্রথম প্রজন্ম সৃষ্টি করেছিলেন। নিজের চোখে দেখলাম, ছোট আকারে প্রীতীশদার ব্যবসা। চলচ্চিত্র ও মিডিয়া। জীবনের শেষ অধ্যায়ে তাঁর মিডিয়া কোম্পানি ‘প্রীতীশ নন্দী কমিউনিকেশনস’-এর মাধ্যমে বিনোদন শিল্পে আধুনিক ধারণা ও পেশাদারিত্বের সূচনা করেন। সংস্থা থেকে ‘ঝংকার বীট্স’, ‘চামেলী’, ‘হাজারো খোয়াইসে অ্যাইসি’-র মতো একাধিক সফল ছবি তৈরি হয়েছে। প্রমাণ করেছেন, সৃজনশীলতা এবং ব্যবসা-বুদ্ধি একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।
কোম্পানির প্রথম অনুষ্ঠান ছিল ‘দ্য প্রীতীশ নন্দী শো’ নামে একটি চ্যাট শো, যা ভারতের পাবলিক ব্রডকাস্টিং চ্যানেল, দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হয়েছিল। এটাই ভারতীয় টেলিভিশনের প্রথম সিগনেচার শো। এমন জনপ্রিয় হল যে ছোটরা ছবিতে যদি টেলিভিশন আঁকে তাহলে চৌকো বাক্সের মধ্যে একটা ন্যাড়া মাথা মুখ আঁকে। ভারতের প্রথম ইংরেজি টক শো, যা সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজের আলোচিত ব্যক্তিদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতা দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছিল। সেই অনুষ্ঠানে আমার একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। অনুষ্ঠানের শুরুর আকর্ষণ, আমার আঁকা সব অতিথির অ্যানিমেটেড জলরঙের প্রতিকৃতি। কখনও শুটিং দেখতে যেতাম এবং সেখানে বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়ে যেত।
ব্যবসা-বাণিজ্য শিখে এসে করেননি, তাই প্রীতীশদাকে স্বশিক্ষিত ব্যবসায়ী বলা যেতে পারে। এরপর ওঁর কোম্পানি পি.এন.সি, দূরদর্শন, জি-টিভি এবং সোনি টিভিতে ৫০০-টিরও বেশি সংবাদ এবং বর্তমান বিষয়ের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছে। ৩০ বছরে, ২৪-টি ছবি নির্মাণ, যা অসংখ্য পুরস্কার এবং সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেছে। এই সব সিনেমায় তাঁর সাহিত্যভাবনা স্পষ্ট। গল্পের মাধ্যমে বাস্তব জীবন, মনস্তত্ত্ব এবং সংস্কৃতির সংমিশ্রণ।
সেবামূলক কাজ হিসেবে ওঁর একটা বড় কাজ ছিল প্রাণী সুরক্ষার অর্গানাইজেশন, ‘পিপল ফর অ্যানিম্যালস’ প্রতিষ্ঠা এবং মেনকা গান্ধীর সঙ্গে একজোট হয়ে সেটার পরিচালনা করা। সেখানেও আমরা অনেকেই অংশ নিয়েছি। প্রাণীদের রক্ষণাবেক্ষণ, চিকিৎসা, হসপিটাল, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি ব্যাপারে অর্থ সাহায্যের জন্য আমি একবার ৬৩-টা ছবির বড়সড় একক চ্যারিটি শো করেছি– প্রথমে মুম্বইয়ে, জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি এবং পরে দিল্লির পার্ক হোটেলে। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই প্রাণী-প্রীতির সুবাদে প্রীতীশদা পুরোপুরি নিরামিষাশী হয়ে যান।
কবিতা, প্রীতীশ নন্দীর প্রথম প্রেম। তাঁর লেখায় থাকে নাগরিক জীবনের জটিলতা, প্রেমের সূক্ষ্ম অনুভূতি এবং সময়ের প্রতিবিম্ব। কবিতা নিয়ে নানান ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কবিতা লিখেছেন ইংরেজিতে। কবিতার জন্য ‘পদ্মশ্রী’ পেয়েছেন মাত্র ২৬ বছর বয়সে। কবিতা লিখেছেন ক্যানভাসে। হাতের লেখা চমৎকার। ক্যালিগ্রাফি ওঁর আরেকটি পছন্দের বিষয়। করেছেন কবিতা-ছবির যুগলবন্দি বই। আমার দুটো বই আছে প্রীতীশদার সঙ্গে– ‘রুপা’ পাবলিকেশনের। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অমিতাভ বচ্চন এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে তারকাদের নিয়ে সাড়ম্বর দুটো কবিতা-ছবির যুগলবন্দি প্রদর্শনী করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। একটা মুম্বইয়ে, অন্যটা কলকাতায়। যেখানে উনি ওঁর নিজস্ব সুন্দর ক্যালিগ্রাফিতে কবিতা লিখেছেন সরাসরি ছবির উপরে, একই ক্যানভাসে।
প্রীতীশ নন্দীর সাংবাদিক জীবনের শুরুতেই আমরা পাই তাঁর সম্পাদকীয় শিল্পদৃষ্টি আর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী মানসিকতা। ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’ কিংবা পরে ‘দ্য সানডে অবজারভার’, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি শিল্প, সাহিত্য এবং সংবাদকে সংযুক্ত করে এমন একটি মানস তৈরি করেছিলেন যা মূলধারার বাইরে গিয়েও গভীর পাঠ তৈরি করে। আমার সুযোগ হয়েছে এই দুটো বিখ্যাত প্রকাশনায় প্রায় পুরোটা সময়ই ওঁর পাশে থেকে কাজ করার।
ইলাস্ট্রেটেড উইকলির কভার পেইন্টিং, লেখার সঙ্গে ছবি ছাড়াও আমার নিয়মিত কলাম ছিল ‘মোল্লা নাসিরউদ্দিন’, কমিকস এবং তার সঙ্গে প্রায় পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে একটা জলরঙের ছবি। যেটাকে বলা যেতে পারে ম্যাগাজিনে জলরঙের কলাম। পত্রিকা ছাপা হত ফোটোগ্রেভিওর প্রসেসে। ছবির রং এবং টোনাল কোয়ালিটি সাংঘাতিক সুন্দর হত ঐ ছাপার পদ্ধতিতে। মোল্লা নাসিরউদ্দিনের জনপ্রিয়তা খুব বেড়ে গিয়েছিল। প্রচুর চিঠিপত্র আসত পত্রিকার অফিসে, এমনকি ‘রুপা’ এটাকে বই আকারেও বের করার অফার দিয়েছিল আমাকে। জনপ্রিয়তা বাড়তে বাড়তে মুম্বইয়ে একটা সিনিয়র সিটিজেনদের মোল্লা নাসিরুদ্দিন ক্লাবও শুরু হয়ে গেল। রঘুবীর যাদব করলেন টেলিভিশন সিরিজ।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া ছেড়ে আম্বানিদের কাগজ ‘সানডে অবজার্ভার’-এ যোগ দিলেন প্রীতীশদা। কাগজকে রাতারাতি পপুলার করার জন্য উনি জুড়ে দিলেন সিনেমা বিভাগ। আমাকেও সঙ্গে জড়িয়ে নিলেন আর দিলেন পুরো ব্রড সিটের একটা ফুল পেজ, যেখানে ফিল্মস্টারদের মুখ আঁকতে হবে। কাগজ যেমন পপুলার হল, আমিও তেমনই পপুলার হয়ে গেলাম মুম্বইয়ে।
ফিল্মস্টারদের পোস্টার এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে ইয়ং ছেলেমেয়েরা হোস্টেলে ফিল্মস্টারদের ফটোর পরিবর্তে আঁকা ছবির ওই মুখ লাগিয়ে রাখত দেয়ালে, আলমারির গায়ে। বহু লোক ওটা সংগ্রহ করার জন্য রোববারের কাগজটা কিনত এবং পাতাটা ওজনদরে কাগজ বিক্রি করার সময় আলাদা করে রেখে দিত। এমনও শুনেছি অনেকের কাছে আজ অবধি সেগুলো সযত্নে রাখা আছে।
জনপ্রিয়তা এবং ওই পোস্টার সংগ্রহের গল্প আস্তে আস্তে আরও অনেক বাড়তে থাকল। মুম্বইয়ে রাস্তার ধারের জুতো সারাইওয়ালা, চায়ের দোকানদার, ফুচকা, তেলেভাজা, এমনকি সান্ধ্য চাইনিজ খাবারের দোকানের পিছনে পাঁচিলের গায়ে দেখা যেতে লাগল আমার ছবির মুখ। কলকাতায় স্কুলের আঁকার ক্লাসের বোর্ডে পিন দিয়ে আটকানো ফিল্মস্টারদের মুখ। পরে শুনেছিলাম সিমলার স্টেশনে, স্টেশন মাস্টার তাঁর তারের জাল লাগানো খাঁচাওয়ালা নোটিশ বোর্ডে প্রতি রোববার বদলে বদলে ওই পোস্টারগুলো লাগাতেন। আমার ছবির প্রদর্শনী হয়ে গেল যেন পাহাড়ি রেলওয়ে স্টেশনে। আরও বড় খবর, কলকাতার সংবাদ সংস্থা, স্টেটসম্যান-এর আর্ট ডিপার্টমেন্টের দেয়ালে নাকি পরপর লাগানো হয়েছে সব পোস্টার।
কাজটাকে কখনও বাণিজ্যিকভাবে দেখিনি আমরা তখন। জলরঙে যে রং, সেটা ঠিক ঠিক যতটা সম্ভব আনা যায় তার জন্য টাটা প্রেসে, যেখানে সানডে অবজারভার ছাপা হত, সেখানে আমি রাতের পর রাত গিয়ে প্রুফ দেখতাম নিজের উৎসাহে। ছাপার সময়ে দাঁড়িয়ে থেকে ইংক ফিডিং দেখতাম। ছাপাখানার লোকগুলোর সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অনেকগুলো কারিগরি দিক সেখানে হাতে-কলমে দেখতে পেতাম এবং শিখতে পারতাম। অতএব যেভাবে সাধারণ ছাপা হয় সেভাবে না হয়ে, ওরা আমার কথামতো কখনও প্লেট বদল করত, কখনও কখনও মেশিন থামিয়ে ইংক ফিডিং ঠিক করত। তার ফলে যতটা রেজাল্ট হওয়ার কথা তার থেকে অনেক বেশি ভালো রেজাল্ট হত এই ছবি ছাপাতে।
‘বন্ধু’ শব্দের মানে আলাদা করে শিখিয়েছিলেন প্রীতীশদা। বন্ধু শব্দের অর্থ উনি দেখিয়েছেন আচরণে। খুব সহজে ওঁর বন্ধু হওয়া যায় না। আমিও শুরুতে ওঁর অফিসে গিয়ে বাইরে বসে থাকতাম। তারপরে যখন আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকল, উনি আমাকে শুধু বন্ধু নয় পরিবারের একজন করে নিলেন। আসতেন আমার বাড়িতে কখনও একা, কখনও সপরিবার। আমরাও যেতাম ওঁর বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়া, আমোদ-আহ্লাদ, অনেক কিছু। একদিন নিজে আমাকে একটি অসাধারণ কথা বললেন, সেটা হচ্ছে, তুমি অফিসে এসে আমার কেবিনের বাইরে রিসেপশন এরিয়াতে বসে থাকবে না। তুমি রিসেপশনের ছেলেমেয়েদের বন্ধু নও। আমি ভেতরে যেমন পরিস্থিতিতেই থাকি না কেন তুমি এসে সরাসরি দরজা ঠেলে আস্তে করে ঢুকে পড়বে। যদি ব্যস্ত থাকি ভিতরে বসে বই পড়বে কিন্তু বাইরে আর ওয়েট করবে না। এমনকী দরজা নক করারও দরকার নেই। তৈরি হল বন্ধুত্বের নতুন সংজ্ঞা– ‘ডোন্ট নক, জাস্ট কাম ইন’। সে ছিল এক মস্ত অধিকার।
প্রীতীশদা চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে চাইলেন। আস্তে আস্তে চাকরি ছাড়ার সময় হয়ে এল আমারও। দেখলাম বাইরের কাজ আর অফিসের কাজ একসঙ্গে করা যায় না, মানে দু’ নৌকায় পা দিয়ে চলা যাবে না। তাই সায়েন্স মিউজিয়ামের উঁচু পদের চাকরিটা কপাল ঠুকে ছেড়েই দিলাম। জীবনের সমস্ত সময় আমার নিজের হয়ে গেল। মজার ব্যাপার, চাকরি ছাড়ার জন্য যে পদত্যাগপত্র, সাহিত্যসুলভ ভাষায় লেখা সেই চিঠি লিখিয়ে নিয়েছিলাম প্রীতীশদাকে দিয়ে। সে চিঠিটাতে ছিল আমার অচরণের ছাপ।
ঘটনাচক্রে আমরা দুজনেই একসঙ্গে চাকরি ছেড়ে স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছামতো কিছু করতে চাইলাম। সে আজ ৩০ বছরেরও বেশি পুরনো দিনের কথা। দু’জনের দুটো পথ একেবারেই আলাদা হয়ে গেল। উনি মিডিয়া ব্যবসায় নামলেন; আমি হয়ে গেলাম পুরো সময়ের জন্য ছবি আঁকিয়ে। পরিবারের মতো যোগাযোগটা পুরোপুরিই ছিল। আমার ছবির প্রদর্শনীতে উনি আসতেন নিয়ম করে বৌদিকে নিয়ে। আমি বাড়ি কিনে মুম্বইয়ের একেবারে পুরোপুরি বাসিন্দা হয়ে গেলাম। সে ব্যাপারেও টাকা জোগাড় করতে সাহায্য করেছেন। শেষ যেদিন ফোনে কথা হল, নিজে মুখেই ওঁর অসুস্থতার খবরটা বলেছিলেন। সঙ্গে অন্য কথা প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, আজকের দিনের সংবাদপত্রের যে দুর্দশা সেখানে নতুন করে নির্ভীক একটা সংবাদপত্রের প্রয়োজন। ইচ্ছে করে, নতুন করে একটা সংবাদপত্র তৈরি করি।
তাঁর উত্তরাধিকার কেবল শিল্পে নয়, চিন্তায়। একজন সৃষ্টিশীল মানুষের দায়িত্ব কী হতে পারে, তা তিনি শিখিয়ে গেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম আজও নতুন প্রজন্মের কবি, সম্পাদক ও শিল্পীকে একটি বার্তা দেয়– সাহিত্য ও শিল্প হোক সত্যনিষ্ঠ, পর্যবেক্ষণমুখী এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদের ভাষা। কীভাবে একজন ব্যক্তি একাধিক ক্ষেত্র জয় করতে পারেন নিজের প্রতিভা, পরিশ্রম ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, প্রীতীশ নন্দীর জীবন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের শেখায়– জীবনে সাফল্যের একমাত্র পথ, নিরলস চেষ্টা এবং নিজের ওপর বিশ্বাস। বাংলা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে প্রীতীশ নন্দীর নাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ৩৭। সুনীল দাসের ছবি আঁকা ছিল কাগজে পেনসিল না ঠেকিয়ে একটু ওপরে, যেন হাওয়াতে ড্রইং হচ্ছে
পর্ব ৩৬। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমারের বাংলার হরফ সংস্কারের কাজই সত্যজিৎকে টাইপোগ্রাফি চর্চার দিকে ঠেলে দিয়েছিল
পর্ব ৩৫। যদি সত্যিই কোনও কিছুকে ভালোবাসো, তবে সাহসী হও– বলেছিলেন ড. মুকেশ বাত্রা
পর্ব ৩৪। শক্তিদার ব্র্যান্ড কী? উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বাংলায় কোনও ব্র্যান্ড হয় না’
পর্ব ৩৩। পত্রিকা পড়তে ছোটদের যেন কোনও অসুবিধে না হয়, খেয়াল রাখতেন নীরেনদা
পর্ব ৩২ । কে সি দাশের ফাঁকা দেওয়ালে আর্ট গ্যালারির প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বীরেনদা
পর্ব ৩১। কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে, আমার জন্য তেজপাতা আর পাঁচফোড়ন নিয়ে এসেছিলেন অহিদা
পর্ব ৩০। হাতের লেখা ছোঁয়ার জন্য আপনার ছিল ‘ভানুদাদা’, আমাদের একজন ‘রাণুদিদি’ তো থাকতেই পারত
পর্ব ২৯। পুবের কেউ এসে পশ্চিমের কাউকে আবিষ্কার করবে– এটা ঢাক পিটিয়ে বলা দরকার
পর্ব ২৮। অন্ধকার নয়, আলো আঁকতেন গণেশ পাইন
পর্ব ২৭। প্রীতীশ নন্দীর চেয়েও কলকাতা ঢের বেশি চেনা অমিতাভের!
পর্ব ২৬। রুদ্রদা, আপনার সমগ্র জীবনযাত্রাটাই একটা নাটক, না কি নাটকই জীবন?
পর্ব ২৫। ক্ষুদ্রকে বিশাল করে তোলাই যে আসলে শিল্প, শিখিয়েছিলেন তাপস সেন
পর্ব ২৪: নিজের মুখের ছবি ভালোবাসেন বলে জলরঙে প্রতিলিপি করিয়েছিলেন মেনকা গান্ধী
পর্ব ২৩: ড. সরোজ ঘোষ আমাকে শাস্তি দিতে চাইলেও আমাকে ছাড়তে চাইতেন না কখনও
পর্ব ২২: মধ্যবিত্ত সমাজে ঈশ্বরকে মানুষ রূপে দেখেছেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ২১: ‘তারে জমিন পর’-এর সময় আমির খান শিল্পীর আচার-আচরণ বুঝতেই আমাকে ওঁর বাড়িতে রেখেছিলেন
পর্ব ২০: আমার জলরঙের গুরু শ্যামল দত্ত রায়ের থেকে শিখেছি ছবির আবহ নির্মাণ
পর্ব ১৯: দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরতেন জয়াদি, না, কোনও স্টাইলের জন্য নয়
পর্ব ১৮: সিদ্ধার্থ যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা-জগতের কবি
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল