১৯ জুলাই বিপ্লবী কবি মায়াকোভ্স্কির জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হল। মহা সমারোহে অবশ্যই নয়। মায়াকোভস্কি স্কোয়ার নামে পরিচিত স্কোয়ারটি কবির জন্মশতবর্ষেই নাম পাল্টে হয়ে গেছে Victory Square। স্কোয়ারে এখনও খাড়া রয়েছে কবির মূর্তিটি। পৃথক পৃথক সময়ে ডেমোক্রেট এবং কমিউনিস্ট– দুই পক্ষেরই কিছু লোকজনের সমাবেশ ঘটেছিল সেদিন মূর্তির পদদেশে। সংখ্যা খুবই কম– দু’-পক্ষেরই শ’দুয়েক করে। কমিউনিস্টরা তাঁকে ‘বিপ্লবের কবি’ বলে বন্দনা করলেন, ডেমোক্রেটরা বলশেভিকদের শিকার বলে চোখের জল ফেললেন কবির জন্য। দৈনন্দিন সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষের সময় ছিল না ওইসব কূটকচালিতে যোগ দেওয়ার।
৬৮.
পেরেস্ত্রৈকা পর্ব: সংস্কৃতির রূপান্তর
বিশ্ববিখ্যাত সংগীত পরিচালক জুবিন মেহতা, যিনি ১৯৬১ সাল থেকে শুরু করে একটানা ৪৭ বছর Israel philharmonic Orchestra-র সংগীত পরিচালনার পর সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন, ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল মুম্বইতে অনুষ্ঠিত এক সাক্ষাৎকারে তাঁর সুদীর্ঘ সংগীত জীবনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সোভিয়েত সংগীত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। তাঁর কথায়, ইজরায়েলের সেই অর্কেস্ট্রাতে এবং আজও অর্কেস্ট্রার প্রতিটি শিল্পী তাঁর নিজের বাছাই করা; আর “What helped very much in the 1980’s was the influx of immigrants from the Soviet Union. They came on a monthly basis and we have auditions behind curtains. So we don’t know who’s playing – nationality, man, woman, nothing. And they were technically so endowed. Even in the Communist times art was treated as a very important factor.”
প্রসঙ্গত, সোভিয়েত শিল্প ও সংস্কৃতির মান যে কতটা উন্নত ছিল এবং সাধারণ জনমানসে তার যে ব্যাপক প্রতিফলন ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’তেও তার উল্লেখ করেছেন। ‘…পূর্বতন কালে আমীর ওমরাওরাই সে সমস্ত ভোগ করে এসেছেন– তখনকার দিনে যাদের পায়ে না ছিল জুতো, গায়ে ছিল ময়লা ছেঁড়া কাপড়, আহার ছিল আধ-পেটা, দেবতা মানুষ সবাইকেই যারা অহোরাত্র ভয় করে বেড়িয়েছে, পরিত্রাণের জন্যে পুরুত-পাণ্ডাকে দিয়েছে ঘুষ। আর মনিবের কাছে ধুলোয় মাথা লুটিয়ে আত্মাবমাননা করেছে তাদেরই ভিড়ে থিয়েটারে জায়গা পাওয়া যায় না।…’ (‘রাশিয়ার চিঠি’ পত্রসংখ্যা ৬)।
কমিউনিজমের পতনের ফলে কারও কারও মনে আশা জেগেছিল, বুঝি বা রাশিয়ায় শিল্প ও সংস্কৃতির প্রস্ফুরণ ঘটবে, রুশ সংস্কৃতির নতুন স্বর্ণযুগের সূচনা হবে। কিন্তু বাস্তবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে দেশের শিল্প-সংস্কৃতি দারিদ্রের চরম সীমানায় উপনীত হয়েছে, পঙ্গু হয়ে পড়েছে।
সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলি এতদিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভে এবং কেন্দ্রীয় পরিচালনাধীনে অভ্যস্ত ছিল। নয়া অর্থ ব্যবস্থায় তারা মুহূর্তের মধ্যে কাজের স্বাধীনতা পেয়ে গেল। বিভিন্ন সরকারি নির্দেশ আর মুদ্রাস্ফীতির ফলে তাদের অনুদান হ্রাস পেল। সরকারি সংস্থাগুলির পরিচালকরা যিনি যেমনভাবে পারেন অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলায় লেগে গেলেন। সবচেয়ে বেশি অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেল সোভিয়েত ব্যবস্থার গৌরব ও গর্বের সামগ্রী নামজাদা মিউজিয়াম থিয়েটার, সংগীত বিদ্যালয় ও ব্যালে থিয়েটারগুলি।
বেশ কিছু ব্যালে ও মিউজিক স্কুল ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফল হয়েছে এই যে-থিয়েটার আর যুব প্রতিভার অফুরন্ত সরবরাহের ওপর নির্ভর করতে পারছে না। বহু নট-নটী আবার সামান্য কয়েক ডলার মাসিক বেতনের ভিত্তিতে বিদেশের সঙ্গে সাময়িক চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন। এর ওপর থিয়েটার কর্তৃপক্ষের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
হাল আমলে বলশয় থিয়েটার পরিবেশিত বস্তাপচা অপেরা, দেশের বড় বড় মিউজিয়াম ও সংগীত বিদ্যালয়গুলির দালানকোঠার জীর্ণদশা আর সস্তার মন-মাতানো নাটক– যারা তা দেখতে যাচ্ছে সেই জনসাধারণ তার চেয়েও বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির মার্কিন ফিল্মে যা সিনেমা হলগুলিতে ও দূরদর্শনে দেখানো হচ্ছে। সর্বত্র প্রকট হয়ে উঠছে পশ্চিমের অপসংস্কৃতির কাছে প্রায় আত্মসমর্পণ, সাংস্কৃতিক নিঃস্বতা, দারিদ্র ও হতাশা।
সংস্কৃতি দপ্তর ১৯৯৩ সালের প্রথম কোয়ার্টারের জন্য বলশয় থিয়েটারের বাজেট হ্রাস করে দিয়েছে। ১৯৯৫ সালে বলশয় থিয়েটারের দালান সংস্কার হওয়ার কথা। মেরামতের জন্য সময় লাগবে অন্তত দু’বছর। ওই সময়ের জন্য থিয়েটারের দুশো কর্মী ও এক হাজার নট-নটীর স্থান কোথায় হবে। সে-সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। সংস্কারের জন্য দরকার অন্তত তিরিশ কোটি ডলার বিদেশি পুঁজি। সে-টাকাও কোথা থেকে আসবে জানা নেই।
আগেকার সরকার যেখানে দেশের বাজেটের শতকরা তিন-চার ভাগ সংস্কৃতির জন্য বরাদ্দ করতেন, সেখানে বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে এক শতাংশেরও নীচে। পুরনো সোভিয়েত শিল্পী সমিতি ও সংঘগুলি এখন আর সরকারের বিন্দুমাত্র আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে না, ফলে ভেঙে পড়েছে। থিয়েটারগুলির সাজ-সরঞ্জাম এত পুরনো হয়ে গেছে যে জীবনের পক্ষে বিপজ্জনক। সোভিয়েত ব্যবস্থা শিল্পী, সাহিত্যিক এবং অন্যান্য সৃজনশীল বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিত এবং পাঠক, দর্শক ও শ্রোতাদের সঙ্গে তাদের মেলামেশার সুযোগ করে দিত। এখন সেই ব্যবস্থাও আর নেই। কিন্তু পুরনো প্রচারযন্ত্র যেহেতু নতুন সরকারের হাতে এবং তারও প্রচারপদ্ধতি যেহেতু পূর্বতন সরকারেরই মতো, সেহেতু প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে কেউ সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন না– বরং কেউ কেউ ছিটেফোঁটা কিছু পাওয়ার আশায় চাটুকারিতায় নেমেছে– সেই আগেকার মতো।
পুরনো স্টুডিয়োগুলিতে ফিল্ম তোলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, ব্যক্তিগত বিনিয়োগ যদি কেউ করেও তা অনিয়মিত, আর অনেক সময় তার উৎস রীতিমতো সন্দেহজনক। যে স্বল্পসংখ্যক ছবি তোলা হচ্ছে তা থেকে লাভের বিশেষ কোনও আশা নেই – হলিউডের সস্তা ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারছে না।
বড় রকমের স্বাধীনতা পেলেই যে সংস্কৃতি আরও গভীর অর্থবহ ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে তা বলা যায় না– বর্তমানে পশ্চিমের, বিশেষত মার্কিন দেশের বর্তমান শিল্প-সংস্কৃতিই তার প্রমাণ। কিন্তু সংস্কৃতি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর কথায়, ‘আমরা এখন দরিদ্র, কিন্তু আমাদের গর্ব এই যে আমরা স্বাধীন।’
মায়াকোভ্স্কি থেকে ম্যাকডোনালড্স
মস্কো, ২৫ জুলাই, ১৯৯৩
শহরের রঙ্গমঞ্চগুলিতে নাটক জমছে না। বলশয় থিয়েটারের ব্যালে সব সময়ই দেশের বাইরে অনুষ্ঠান পরিবেশন করে বেড়াচ্ছে। যখন দেশে তখন তার শো-এর টিকিট সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সোভিয়েত আমলে প্রচলিত উৎসবগুলি একে একে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। দু’-একটি নামমাত্র প্রচলিত থাকলেও তাদের সেই জৌলুশ আর নেই– প্রকাশ্যে উদযাপিত হয় না– উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত মিছিল শোভাযাত্রা পুলিশের হস্তক্ষেপে রণক্ষেত্রের আকার ধারণ করে।
একটু ভুল বললাম। সোভিয়েত আমলে ইস্টার বা খ্রিস্টমাসের মতো উৎসবগুলি অনেক পরিবারের বাড়িতেই উদযাপিত হতে দেখেছি। প্রকাশ্যে নয়। গির্জাতেও উদযাপিত হত, কিন্তু এখন সেগুলি রাস্তাঘাটের জৌলুশে পরিণত হয়েছে। অন্য দিকে সোভিয়েত আমলের উৎসবগুলি ঘরোয়া পর্যায়ে চলে গেছে। অর্থাৎ যা ছিল ঘরের, তা বাইরে বেরিয়ে পড়েছে, আর যা বাইরে ছিল তা ঘরের ভেতরে গিয়ে লুকিয়েছে।
তাছাড়াও উৎসব ও আনন্দের আরও নতুন নতুন খোরাকও শহরে এসে জুটছে। শহরে একের পর এক খোলা হচ্ছে বিদেশি চটজলদি খাবারের দোকান– ম্যাকডোনাল্ডের দোকান। সেদিন এই নিয়ে খোলা হল তৃতীয়টি। প্রথমটি খোলা হয়েছিল কবি পুশকিনের নামাঙ্কিত স্কোয়ারে– পেরেস্ত্রৈকার প্রথম আমলে। এ-বছর জুলাইয়ের প্রথমে খোলা হল পুশকিন ভবনের কাছে।
এরকম এক-একটি উদ্বোধন রাশিয়ার এক-একটি আধা-সরকারি উৎসব। এর আগেরটি উদ্বোধনের সময় স্বয়ং প্রেসিডেন্ট উপস্থিত ছিলেন। এবারে প্রথম খাবারের আস্বাদ গ্রহণ করলেন ইয়েলৎসিনের পরিবারের লোকেরা এবং সরকারি প্রতিনিধিরা। সংস্কৃতি বিদেশে চালান হয়ে যাচ্ছে, তার বদলে বিদেশ থেকে আসছে স্যান্ডউইচ। সেইসঙ্গে ফাউ– রাস্তায় রাস্তায় উড়ছে ম্যাকডোনাল্ডের পতাকা, উড়ছে ম্যাক ডোনাল্ডসের চিহ্ন বুকে নিয়ে বেলুন। বেলুনে দোল খাওয়াচ্ছে শহরের কচি-কাঁচাদের। সকলের হাতে হাতে ঘুরছে ভিনদেশি খাবারের দোকানের পতাকা– এরও রং আবার লাল।
এরই মধ্যে টুকরোটাকরা সংস্কৃতি সংবাদ। ১৯ জুলাই বিপ্লবী কবি মায়াকোভ্স্কির জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হল। মহা সমারোহে অবশ্যই নয়। মায়াকোভস্কি স্কোয়ার নামে পরিচিত স্কোয়ারটি কবির জন্মশতবর্ষেই নাম পাল্টে হয়ে গেছে Victory Square। স্কোয়ারে এখনও খাড়া রয়েছে কবির মূর্তিটি। পৃথক পৃথক সময়ে ডেমোক্রেট এবং কমিউনিস্ট– দুই পক্ষেরই কিছু লোকজনের সমাবেশ ঘটেছিল সেদিন মূর্তির পদদেশে। সংখ্যা খুবই কম– দু’-পক্ষেরই শ’দুয়েক করে। কমিউনিস্টরা তাঁকে ‘বিপ্লবের কবি’ বলে বন্দনা করলেন, ডেমোক্রেটরা বলশেভিকদের শিকার বলে চোখের জল ফেললেন কবির জন্য। দৈনন্দিন সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষের সময় ছিল না ওইসব কূটকচালিতে যোগ দেওয়ার।
বোধোদয়
মস্কো, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯১
প্রবীণ ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা– এখানকার ভারতীয় কমিউনিস্ট মহলে অন্তত তাই ছিলেন– এই কিছুদিন আগেও। এসেছিলেন আজ থেকে বছর ৩৪ আগে। পার্টির কর্মসূত্রে। সঙ্গে ছিল দেশের অর্জিত ডাক্তারি ডিগ্রি। তারপর আর দেশে ফেরেননি। তখন যুবক। রোমান্স। এখানেই বিয়ে করে পাকাপাকি ঘর বাঁধলেন। স্ত্রী, দুই কন্যা আর দৌহিত্র নিয়ে সুখের সংসার। পেশাটা অন্তত আমাদের দেশে রীতিমতো লোভনীয়– দেশে থাকলে অনেক টাকাপয়সা করতে পারতেন। কিন্তু পোড়া সমাজতন্ত্রে থেকে ওই জীবিকায় পেটে-ভাতে থাকা যায়, কলাটা-মুলোটা মেলে– এর বেশি কিছু নয়। বিলাসিতা চলে না। এছাড়া আরও অনেক হ্যাপা আছে– রোগীর ভালো-মন্দ কিছু হলে রাত জেগে বই পড়ে বিশাল বিশাল রিপোর্ট লিখতে হয়।
ইদানীং বাজার অর্থনীতির কল্যাণে মাইনে তিনশো থেকে বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি– ওভারটাইম নিয়ে অবশ্য। স্ত্রীও রোজগার করেন ওই পরিমাণ। তিনি ‘যুব কমিউনিস্ট লিগ’-এর সদস্য ছিলেন, পরে কমিউনিস্ট পার্টির। একসময় কম্সমোল প্রভ্দার সম্পাদক দপ্তরের কর্মী ছিলেন, এখন ‘ইয়ং গার্ড’ প্রকাশনালয়ের কর্মী। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবারের অবস্থার উন্নতি হয়েছে এমন নয়– বরং অবনতি হয়েছে, খরচ বেড়ে গেছে সাত-আট গুণ। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আগে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করতে এদেশে এলে তাদের কমিউনিজমে দীক্ষা দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যেতেন। কাজের পর সন্ধ্যাবেলা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মার্কসীয় পাঠচক্র পরিচালনা করতেন। পার্টি থেকে এই দায়িত্বই তাঁর ওপর ন্যস্ত হয়েছিল। পার্টির নেতারা চিকিৎসার জন্য এদেশে এলে তাঁদের দেখভাল তিনি করতেন। এখানে তাঁদের কারও মহাপ্রয়াণ ঘটলে শোক সভায় তাঁর ভাষণদান বাঁধা। চাকরি এমনই যে স্বদেশে যাওয়া কদাচিৎ হয়ে উঠত– টিকিট কেনার মতো সংস্থান নেই– কনফারেন্স ইত্যাদিতে যোগদানের জন্য পার্টির কেনা টিকিটে মাঝেমধ্যে দেশে যাওয়ার সুযোগ ঘটত। ইদানীং দেশে যাওয়ার সেই পথও বন্ধ। পেনশন পাওয়ার বয়স অনেক আগে পেরিয়ে গেছে– কর্তাদের দয়ায় আজও বহাল আছেন চাকরিতে– তবে টেনেটুনে আর বছর খানেক। তারপর?
বছর তিনেক আগে পশ্চিমের দ্বার অবারিত হয়ে গেলে জনৈক বন্ধুর আমন্ত্রণে বন্ধুরই কিনে দেওয়া টিকিটে লন্ডন বেড়াতে গিয়েছিলেন– সস্ত্রীক। সেই প্রথম বিলেত-যাত্রা। ফিরে এসে উচ্ছ্বসিত, আবার বিমর্ষও বটে। তাঁর জীবিকার লোকেরা সেখানে যেরকম রাজার হালে আছেন, তা দেখে মুগ্ধ, ঈর্ষান্বিতও। সমাজতান্ত্রিক দেশে তাঁর মতো লোক নিঃস্ব। তিনি বঞ্চিত। সারাটা জীবন কিনা কেটে গেল এই বোধোদয় হতে!
ইতিমধ্যে পেরেস্ত্রৈকা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিরাট ওলটপালট হয়ে গেছে দেশে-বিদেশে। স্বপ্নভঙ্গ কি না জানি না, ভদ্রলোকের সম্পূর্ণ মোহভঙ্গ যে হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এক কথায় তিনি এখন গোত্রান্তরিত। মস্কোয় গত দু’-বছর হল স্থানীয় বাঙালি সমাজ মহা ধুমধাম সহকারে দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করে আসছে হলঘর ভাড়া নিয়ে।
এবারে ওই পূজার দালানেই কথা হচ্ছিল দীর্ঘকালের পরিচিত সেই ভদ্রলোকটির সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, লেনিন থেকেই নাকি বর্বর বলশেভিকবাদের সূচনা। লেনিন নিজে নাকি গির্জা ধ্বংসের আদেশ দিয়েছিলেন, তাঁর সেই নির্দেশনামা ইদানীং পত্রিকায় ছাপা হয়ে বেরিয়েছে– তিনি নিজে পড়েছেন। আমি বললাম যে তিন বছর আগেই পেরেস্ত্রৈকার কল্যাণে এখানকার এক সাময়িক পত্রিকায় বেরিয়েছিল, তখন পড়েছি, কিন্তু ওই নির্দেশনামার প্রামাণিকতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে, যেহেতু সম্পাদকমণ্ডলীকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে ওটা একটা কপি– মূল পাওয়া যায়নি। আমার কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন, যেন একটু দমেও গেলেন।
পরবর্তী প্রসঙ্গ স্তালিন। ইদানীং তিনি স্তালিন-নন্দিনীর স্মৃতিকথা ও পত্রাবলি পড়ছেন– রুশ ভাষায়। পড়ে নাকি তাঁর জ্ঞানচক্ষু আরও উন্মীলিত হচ্ছে। আমি বললাম, ও বই তো আমরা একযুগ আগে পড়েছি ইংরেজিতে। তবে ওখানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বিশেষ কিছু নেই। প্রসঙ্গত, ওই লেখার জন্য স্তালিনকন্যা সভেলানাকে প্রচুর আগাম দিয়ে মার্কিন প্রকাশকের পথে বসার মতো অবস্থা হয়েছিল– বাজারে তার তেমন কাটতি হয়নি। এটাও তাঁর কাছে নতুন খবর। শেষকালে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে রচনাশৈলীর প্রশংসা করলেন। আমি বললাম, স্তালিনের রচনাশৈলীর প্রশংসায় একসময় আপনাদের পঞ্চমুখ হতে শুনেছি। এমনকী রুশ ভাষায় তাঁর যে অগাধ জ্ঞান ছিল এবং যে কোনও রুশির চেয়ে তিনি ভালো রুশ জানতেন তাও পড়েছি তাঁর সেক্রেটারির স্মৃতিচারণে।
ততক্ষণে পূজা শেষ হয়েছে। তিনি এগিয়ে গেলেন, সকলের সঙ্গে প্রদীপের আগুন ছুঁয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুদ্ধ হতে। ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। ফিরে এসে আবার যখন আমার পাশে এসে বসলেন তখন আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম তিনি এখনও পার্টি-সদস্য আছেন কি না। উত্তরে তিনি আরেক নতুন কথা শোনালেন। আগে ওখানে থেকে সদস্য চাঁদা দেশে পাঠানোর উপায় ছিল, এখন আর সেই উপায় নেই। সুতরাং চাঁদা দেওয়া বন্ধ, তাই বলতে পারছেন না সদস্যপদ আছে কি নেই। এরপর আর কোনও কথা চলে না।
এরপর ২০১০ সালে চলে আসছি। এতদিন পরে আর কোনও কিছুতেই মনে বিস্ময় জাগে না, আজ বছর ছয়েক হল সেই প্রাক্তন কমিউনিস্ট কর্মীটি প্রয়াত হয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তাঁর স্ত্রী– এককালের পার্টি-সদস্য– যথারীতি খ্রিস্টধর্ম মতে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
৬৭। ভোদ্কাই কি দেশের একমাত্র রক্ষাকবচ?
৬৬। বেসরকারিকরণের সুযোগে যে বেকারি তৈরি হয়, তা সরাসরি দেখলাম সোভিয়েতে
পর্ব ৬৫। যে মহাকাশচারী মহাকাশেই এক যুগ থেকে আর একযুগে এসে যাত্রা শেষ করেছিলেন
পর্ব ৬৪। লেনিনের স্থান কোথায় হবে– তা নিয়ে আজও রাশিয়ায় তর্ক চলছে
পর্ব ৬৩। উত্তরের আশায় লেনিনকে সমাধির ঠিকানায় চিঠি পাঠাত সাধারণ মানুষ
পর্ব ৬২। মিখাইল নিল ভোদকা কেড়ে, বরিস দিল ভাত মেরে
পর্ব ৬১। প্রকাশের স্বাধীনতার আমলে সোভিয়েত থেকে হারিয়ে গেল চুটকি বা হাস্যরস
পর্ব ৬০। রুশ দেশের হাস্যরস যেন লোকসাহিত্যের এক অফুরান ভাণ্ডার
পর্ব ৫৭। গুরুগম্ভীর থেকে হাস্যকরের তফাত মাত্র একটি পদক্ষেপের
পর্ব ৫৬। রুশ দেশের অনেক খবরই আজকাল গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ঠাঁই পাওয়া শুরু করেছে
পর্ব ৫৫। মার্কিন দেশে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে এসেছিল একজন গর্বাচ্যোভের মুখোশ পরে, অন্যজন মাইকেল জ্যাকসনের
পর্ব ৫৪। হাজার হাজার কৌতূহলী জনতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই মহাদৃশ্য
পর্ব ৫৩। নাম বদলের গোলকধাঁধায় অসঙ্গতি বেড়েছে, ঐতিহ্যকে রক্ষা করা যায়নি
পর্ব ৫২। মস্কোর আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মিছিলে ভারতের পতাকা থাকবে না-ই বা কেন?
পর্ব ৫১। পত্র-পত্রিকায় ঘোষণা করা হল কাস্ত্রো আসছেন, তবে ইনি মেক্সিকোর সোপ অপেরা স্টার
পর্ব ৫০। খোলা হাওয়ায় মানুষের আর কোনও কিছু নিয়েই চিন্তা নেই, অন্ন চিন্তা ছাড়া
পর্ব ৪৯। সোভিয়েত-মুক্ত রাশিয়াকে কে রক্ষা করবে?
পর্ব ৪৮। বর্ষশেষে মানুষ পেল দারিদ্র, এখন লোকে ধার-দেনা করে চা-কফি খাওয়া শুরু করেছে
পর্ব ৪৭। মুক্ত দিনে ব্যালের দেশ রাশিয়ায় ‘আধুনিক ব্যালে’ শেখাতে আসছে ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রুপ
পর্ব ৪৬। অক্টোবর বিপ্লবের উচ্ছ্বাস কোনও দেশে কমলে, অন্য দেশে বাড়তে থাকে
পর্ব ৪৫। ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ আর পালিত হবে না, পালিত হবে বড়দিন– চোখের সামনে বদলে যাচ্ছিল সোভিয়েত
পর্ব ৪৪। রাজনীতিতে অদূরদর্শিতার ফল যে কত সুদূরপ্রসারী, তার প্রমাণ আফগানিস্তান
পর্ব ৪৩। জানলা দিয়ে পূর্ব জার্মানি দেখতে দেখতে গর্বাচ্যোভ বলেছিলেন, তাহলে এখানেই শেষ!
পর্ব ৪২। পেরেস্ত্রৈকা শুরু হলে বুঝেছিলাম ‘প্রগতি’ ‘রাদুগা’– এসব কিছুই থাকবে না
পর্ব ৪১। কল্পনা যোশীর তুলনায় ইলা মিত্রকে অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি বলে মনে হয়েছে
পর্ব ৪০। বেসরকারিকরণের শুরু দিকে রাস্তাঘাটে ছিনতাই বেড়ে গেছিল, কারণ সব লেনদেন নগদে হত
পর্ব ৩৯। হাওয়া বদলের আঁচ অনেকেই আগে টের পেয়েছিল, বদলে ফেলেছিল জীবনযাত্রা
পর্ব ৩৮। শুধু বিদেশে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ করেও ছোটখাটো কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন বহু ভারতীয়
পর্ব ৩৭। একটা বিদেশি সাবানের বিনিময়েও নাকি মস্কোয় নারীসঙ্গ উপভোগ করা যায়– এমনটা প্রচার করেছে ভারতীয়রা
পর্ব ৩৬। মস্কোর ঠান্ডায় লঙ্কা গাছ দেখে পি.সি. সরকার বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে বড় ম্যাজিক হয় নাকি?’
পর্ব ৩৫। রুশদের কাছে ভারত ছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ, হিমালয়ের দেশ
পর্ব ৩৪। সোভিয়েত শিক্ষায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা খামতি থেকে গিয়েছিল
পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে
পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন
পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি