১৯৪২-এ জন্মানো গায়ত্রী আমার থেকে ঠিক এক বছরের ছোট। তাই সেই আয়ত আঁখির বোধদীপিত, প্রায় চেনস্মোকার, ছিপছিপে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তাঁকে দুয়েকবার দেখেছি। এবং একই সঙ্গে বিহ্বল ও মুগ্ধ হয়েছি। তাঁকে অনেক বেশি পাই এখন ইউটিউবে। পৃথিবী জুড়ে তাঁর বিচিত্র বিষয়ে ছড়িয়ে পড়া দ্যুতি, সমস্ত সেখানে আশ্রিত। ক্লান্তিহীন তাঁর এই অন্বেষণ ও প্রকাশ। তুলনাহীন তাঁর অনর্গল যুক্তিবাদী বাগ্মিতা। তাঁর সন্ধান ও প্রকাশের, তাঁর যুক্তির এবং ভাষার কত যে মুহূর্ত জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিতে কী বলব! তখন তিনি তাঁর বিতর্ক উজ্জ্বল, বোধ শাণিত, ভাষায় অব্যর্থ যৌবনে। গোল টেবিলের আর সবাই বিদেশি পুরুষ। একমাত্র নারী তিনি। এবং বাঙালি। হাতে জ্বলছে সিগারেট। সিগারেট মুখে তীব্র আগুনবিন্দু যেন তাঁরই দার্শনিক চেতনা, তাঁরই ধ্যানবিন্দু !
৩২.
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মনই তাঁর লেখার টেবিল। আলাদা কোনও লেখার টেবিল নেই গায়ত্রীর। গায়ত্রী এই বছর পেলেন হলবার্গ পুরস্কারের বিরল গৌরব। যে পুরস্কারের দীধিতি নোবেল পুরস্কারের তুল্য। এই খবরটি পাওয়া মাত্র আমার মনে এল এই কথাটাই, বহু প্রবাহে ধাবমান, বিচিত্র মননে ও সৃজনে লিপ্ত গায়ত্রীর ম্যাজিক মনই ক্রমশ হয়ে উঠেছে তাঁর লেখার টেবিল। কখনও তাঁর প্রয়াস আর ভাবনার শিকড়ে এই সব মূক মুখে দিতে হবে ভাষার প্রবল প্রাণন।
কখনও রামপ্রসাদের গান ইংরেজি অনুবাদে তিনি পৌঁছে দিচ্ছেন অমৃত আন্তর্জাতিকতায়। কখনও তিনি অন্বেষ-আচ্ছন্ন বাস্তুশাস্ত্রের দৈবতার। কখনও তিনি আধুনিকতার অন্য স্তরে সন্ধান করছেন মধ্যযুগীয় গুপ্তচরবৃত্তি। কখনও তিনি অন্তরাল থেকে উদ্ধার করছেন ‘অপর’ সংস্কৃতির অবয়ব। কখনও তিনি প্রবিষ্ট হচ্ছেন পলাশদীপিত পুরুলিয়ার শবর সংস্কৃতির অচেনা রেখাচিত্রে। কখনও তিনি আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস-এর ওপর গভীর গবেষণা গ্রন্থ লিখে তার নাম দিচ্ছেন ‘মাইসেলফ আই মাস্ট রিমেক’! কখনও জাক দেরিদার পথে তিনি খনন করছেন ভাষা বিনির্মাণ সরণি। এমন বিপুল বিদুষীর, এমন বহুমুখী চিন্তকের, এমন সৃজনময়ী পরমার, এমন নদীর মতো অবিরল বহুবহতায় প্রবাহিত হয়েও এমন স্থিতধী উজ্জ্বলার নাগাল পাওয়া সহজ নয়। তার চেষ্টাও করব না। তবু সেই গায়ত্রীকে নিয়েই এবারের কাঠখোদাই। তাঁকে ছাড়া আর কাকে নিয়ে লেখা এই সপ্তাহে মানানসই হত?
১৯৪২-এ জন্মানো গায়ত্রী আমার থেকে ঠিক এক বছরের ছোট। তাই সেই আয়ত আঁখির বোধদীপিত, প্রায় চেনস্মোকার, ছিপছিপে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তাঁকে দুয়েকবার দেখেছি। এবং একই সঙ্গে বিহ্বল ও মুগ্ধ হয়েছি। তাঁকে অনেক বেশি পাই এখন ইউটিউবে। পৃথিবী জুড়ে তাঁর বিচিত্র বিষয়ে ছড়িয়ে পড়া দ্যুতি, সমস্ত সেখানে আশ্রিত। ক্লান্তিহীন তাঁর এই অন্বেষণ ও প্রকাশ। তুলনাহীন তাঁর অনর্গল যুক্তিবাদী বাগ্মিতা। তাঁর সন্ধান ও প্রকাশের, তাঁর যুক্তির এবং ভাষার কত যে মুহূর্ত জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিতে কী বলব! তখন তিনি তাঁর বিতর্ক উজ্জ্বল, বোধ শাণিত, ভাষায় অব্যর্থ যৌবনে। গোল টেবিলের আর সবাই বিদেশি পুরুষ। একমাত্র নারী তিনি। এবং বাঙালি। হাতে জ্বলছে সিগারেট। সিগারেট মুখে তীব্র আগুনবিন্দু যেন তাঁরই দার্শনিক চেতনা, তাঁরই ধ্যানবিন্দু !
এখন বোধহয় সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু আগুনবিন্দুটিকে ছাড়েননি। সেটি জ্বলে তাঁর কপালে ছোট্ট লাল বিন্দিতে। তাঁর ভাষা আর তেমনভাবে বিতর্কের নয়, বরং অনেক বেশি উপলব্ধির, ডুব সাঁতারের। গায়ত্রী বিনির্মিত। এবং নতুনভাবে নির্মিত। ‘মাইসেলফ আই মাস্ট রিমেক’, এই প্রতিশ্রুতি রেখেছেন তিনি।
গায়ত্রীর জীবনে প্রধান ও প্রাণিত প্রশ্ন হল ‘ক্যান দ্য সাব ওল্টার্ন স্পিক?’ প্রান্তিক মানুষের ভাষা আমরাই কি কেড়ে নিইনি? তাদেরও যে কথা বলার অধিকার আছে, এই বোধের আগুনও কি আমরাই নিভিয়ে দিইনি? ছাই উড়িয়ে দেখলে কি কিছু আগুন এখনও চোখে পড়তে পারে না! সেই কথা বলার অধিকারের আদিম আগুন কি জ্বলছে না পুরুলিয়ার পলাশে?
এই প্রশ্ন আমাদের নিয়ে যায় ভাষা রাজনীতির কাটিং এজ দর্শনে, যার সুদীর্ঘ আলোচনা পাওয়া যাবে গায়ত্রী প্রসঙ্গে মর্টন স্টিফেনের বিদগ্ধ গ্রন্থে। সাব অল্টার্ন স্টাডি নিয়ে রণজিৎ গুহর লেখাগুলি না পড়লে কিন্তু গায়ত্রীর অনেক লেখা ও মননের বিস্তার আবছা থেকে যাবে। তাঁর মন কেমনভাবে কোন বিনির্মাণের পথে ক্রমশ হয়ে উঠছে তাঁর মনন ও লেখার টেবিল, সেই অনুভবের বীজটি রোপিত হবে না আমাদের মনের মধ্যে।
গায়ত্রীর অনেক লেখা পড়তে পড়তে আমার অন্তত মনে হয়েছে জীবনে লড়াই আছে– এই কথাটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি, জীবনে পরাজয় বলে কিছু নেই। যাকে আমরা পরাজয় বলে চিহ্নিত করি, সেই অবস্থাটিকে আমরা আসলে ভুল দেখছি। আমাদের জীবন দর্শনকে মেরামত করেন গায়ত্রী। এবং আমি নতজানু হয়ে বারবার গ্রহণ করি তাঁর মেরামতির দর্শন ও দক্ষতা। জীবন পরাজয়হীন, জীবনকে দেখার এই ভঙ্গিটি গায়ত্রী অর্জন করেছেন প্রান্তিকায়িত মানুষের লড়াই ও যাপনবোধ থেকে। ফরাসি তাত্ত্বিকতা, ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট থেকে নয়। কিন্তু একই নিঃশ্বাসে এই কথাও বলতে হবে, ইউরোপীয় দর্শন ও জাগৃতির গভীর প্রভাব পড়েছে গায়ত্রীর মানস গঠনে, ভাবনার প্রসারে। মার্কস থেকে দেরিদা, ফ্রয়েড থেকে ফুকো– ইউরোপীয় আধুনিক ভাবনার সব আলোটুকু শুষে নিয়েছে গায়ত্রীর মন তাঁর লেখার টেবিল হয়ে উঠতে উঠতে। এই টেবিলের একটি পা মহাশ্বেতা দেবী, এই সত্যটুকু তো বলতেই হবে। এমন ব্যাপ্ত গ্রহণ না সম্ভব হলে গায়ত্রীর লেখায় থাকত না এমন প্রসারিত প্রদান। তিনি ভাবতে পারতেন না ‘অফ গ্রামাটোলজি’-র ভাবনা।
লিখতে পারতেন না ‘আউটসাইড অফ টিচিং’-এর মতো লেখা। ‘এথিক্স অ্যান্ড পলিটিক্স ইন টেগোর’ থেকে ‘ইন আদার ওর্ডস’-এর মতো লেখাও থেকে যেত তাঁর নাগালের বাইরে। আর যে-ক’টা উদ্ধৃতি দিচ্ছি গায়ত্রীর লেখা থেকে তাও আসত না তাঁর মননে, যদি না গায়ত্রী শান্তায়িত হতেন দিগন্তবিস্তৃত বৈদগ্ধ ও উপলব্ধিতে:
১। The female intellectual as intellectual has a circumscribed task which she must not disown with a flourish.
২। There is no virtue in global laundry lists with ‘ woman’ as a pious item.
৩ । Autobiography is a wound where the blood of history does not dry.
৪। Let literature teach there are no certainties , that the process is open, that it may be altogether salutary that it is so.
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….
যে-মনের টেবিলে এই ভাবনাগুলি জন্মেছে, উচ্চারিত হয়েছে বাক্যে, ভাষায়, সেই মনকে আদর না জানিয়ে উপায় আছে? তবু ক’জন বাঙালি এই আন্তর্জাতিক বাঙালি মেয়েটিকে জানতে চায়? তাঁকে পড়ে? তাঁকে শোনে?
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল