প্রথম শুটিং-এর সময় অনেকটা নার্ভাস ছিলাম, এখন আর যেটা লাগে না। ঋতুদা অফিস ছেড়ে দিলেও তখনও ‘বস’ বলেই মানি। ভাবলাম তারা-র পুজো প্রোমোটা নিয়ে একটু কথা বলে আসি। আর তিতলি-র গানটা কমপ্লিট। সেটা তো জমা দেওয়ার কথা আছেই। গুনগুন করতে করতে ঋতুদার বাড়ি হাজির হলাম। ঘরে তখন অন্য সব লোক। ঋতুদা বসতে বলল গদিতে, আমি ইশারায় জানালাম গানটা হয়ে গেছে। লোকজন একটু ফাঁকা হতেই বললাম, ‘গানটা শুনবে?’ ঋতুদার গলায় যেন অনেক নিরাসক্তি– ‘শোনা।’
২৯.
কেন আমি অফিসের সময় অন্য অফিসের দপ্তরে বসেছিলাম– সেই কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল শোকজ নোটিশে। অডিও ভিস্যুয়াল আর প্রিন্ট একেবারেই আলাদা দু’টি মিডিয়া। ‘আমার শহর’-এর মতো ম্যাগাজিন প্রোগ্রামের ডিরেক্টর হিসেবে এমনিতেই আমাকে নানা জায়গায় যেতে হত। ফলে কেন অমুক অফিসে, সে প্রশ্ন ধোপে টেকে না। আর দুটো কাজের মধ্যে কোনও ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’ও নেই সেভাবে। একটা সত্যি কথা বলি। আসলে শোকজ নোটিশের কোনও কারণই আমি দেখাইনি। বয়েই গিয়েছিল, ঠিকই করে রেখেছিলাম, অফিস পাঁয়তারা করলে ‘রইল ঝোলা চলল ভোলা’ বলে কাটব।
এর কিছুদিন পরেই শুরু হবে ‘চ’ অ্যালবামের রেকর্ডিং। এমনিই আমায় টানা দশ দিন ডুব মারতে হবে অফিস। ‘গান ভালোবেসে গান’, ‘রোগা বোলো না’– গানগুলো তখন স্টেজে গাইছি নিয়মিত। সে সময় কিছু সাউন্ড কার্ড রেকর্ডিং-এর কাজে ব্যবহার করা হত। উপল এসব ব্যাপারে খুবই পটু। আমাদের ডেমোগুলো ওই সফটওয়্যারে রেকর্ড করতে লাগলাম। একেবারেই প্রফেশনাল নয় কিন্তু ওই সাধারণ সফটওয়্যারেই অ্যালবামের তিনটে গান বাড়িতে রেকর্ড করা হয়েছিল। গানগুলো ছিল ‘দুধ না খেলে’, ‘দুনিয়া ডট কম’, ‘ভালো লাগে না যে’। একদিকে চলছে চন্দ্রবিন্দুর চতুর্থ অ্যালবামের কাজ, অন্য দিকে ‘তিতলি’-র পোস্ট প্রোডাকশন। মাঝখানে দোদুল্যমান ‘তারা’– সময় বটে একখানা! ঋতুদা একদিন ডেকে পাঠাল, খুব নাকি দরকার। এই এক অভ্যেস ছিল বটে। সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল ঋতুদার। সত্যি দরকারের ক্ষেত্রে তাহলে কেমন পাগলামি করত!
আমি বললাম, ‘‘অ্যাঙ্কার লিঙ্ক শুট আছে, দু’দিন পর আসছি।’’
‘শুট শেষ হলেই আসবি, চন্দ্রিলকে নিয়ে।’
তো, দৌড়লাম। কী পরিকল্পনা ফেঁদেছে, শুনি। ঋতুদার প্রস্তাবটা খুব অদ্ভুত ছিল। কতকটা এইরম– ‘তিতলি’ ছবির গোড়ায় একটি শীর্ষসংগীত থাকবে। ‘চন্দ্রবিন্দু’ সেই গানটা করে দেবে কি না? আরে আরে! এ তো পুরো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ঘটনা। ঋতুপর্ণর ছবিতে টাইটেল সং! আমি আর চন্দ্রিল মিলে গান লিখে নিয়ে গেলাম। ঋতুদার মনে হল লিরিকটা বড় বেশি ‘এসোটেরিক’। পপুলার সিনেমা, আরও একটু সহজ করলে ভালো। আমার সবসময় মনে হয়, লিরিক সুর ছাড়া শোনানো ব্যাপারটা, নুন ছাড়া রান্নার মতো। সুর না পড়লে ‘তুমি যে আমার, ওগো, তুমি যে আমার’ লিরিকটা খারাপই লাগত। ফলে আমি একটা আস্ত গান তলে তলে বানাতে শুরু করলাম। মুখরাটা হয়ে গিয়েছিল বেশ তাড়াতাড়ি, কিন্তু অন্তরাটা বানাতে একটু সময় লাগছিল। ঋতুদা এর মাঝে তাড়াও দিয়েছে দু’বার। আমি নিজেই ফোন করে একদিন বললাম, ‘একটু ব্রিফ করো তো গানের থিমটা।’ ঋতুদা একটু ভেবে বলল, ‘একজন নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হওয়া উচিত। আসলে তো ছবিটা রিনাদির। যে একটা একঘেয়ে দাম্পত্যের মধ্যে রয়েছে, দেখছে কিশোরী মেয়ে বড় হয়ে তারই পুরনো প্রেমিককে হিরো ওয়রশিপ করছে। আসল ক্রাইসিসটা এই নারীর। তারই গান হবে।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
যে কোনও মানুষই যখন কিছু বানায়, তখন সেই গান বা কবিতা মানুষটার সঙ্গে সঙ্গে পথ হাঁটে। যত দীর্ঘক্ষণের পথহাঁটা, তত পরিমার্জন, তত পরিশীলন। সুরের ব্যাপারটাও তাই। প্যাটার্নগুলো পাল্টাতে পাল্টাতে চলে। ফলে পছন্দ যাতে হয়, তার জন্য একটু সময় নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে আবার অফিসে কাজের চাপ এসে পড়ল। পুজোয় কতকগুলো প্রোমো তৈরি করতে হবে। কী ধরনের, সে সম্পর্কে কিছু বলা নেই, যেমন খুশি। আমার জীবনে এই আলগা নিয়মগুলো খুব হেল্প করেছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
খুব যত্ন নিয়ে বানিয়েছিলাম কম্পোজিশনটা। মূল জায়গাটা ছিল– ‘যাও ফিরে বৃষ্টি উথালপাথাল, আবার হবেই দেখা আগামীকাল।’
যে কোনও মানুষই যখন কিছু বানায়, তখন সেই গান বা কবিতা মানুষটার সঙ্গে সঙ্গে পথ হাঁটে। যত দীর্ঘক্ষণের পথহাঁটা, তত পরিমার্জন, তত পরিশীলন। সুরের ব্যাপারটাও তাই। প্যাটার্নগুলো পাল্টাতে পাল্টাতে চলে। ফলে পছন্দ যাতে হয়, তার জন্য একটু সময় নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে আবার অফিসে কাজের চাপ এসে পড়ল। পুজোয় কতকগুলো প্রোমো তৈরি করতে হবে। কী ধরনের, সে সম্পর্কে কিছু বলা নেই, যেমন খুশি। আমার জীবনে এই আলগা নিয়মগুলো খুব হেল্প করেছে। ‘যুগান্তর’ অফিসে যখন চাকরি করতাম একদিন হঠাৎ আমাদের বস অন্য কাগজে চলে গেলেন। হারাধনের পাঁচটি ছেলে ঘোরে পাড়াময় দশা তখন। কিন্তু কাগজের হাঁ-মুখ সবচেয়ে বড়, ছাপতে তো হবেই কিছু। অসংখ্য হাঙ্গাম মাঝে লভিলাম নব মুক্তির স্বাদ। তেড়ে নিজেদের মতো করে কাগজ বের করতে শুরু করলাম। ভালো-মন্দ যেমন হোক, একটা উপকার হয়েছিল, কাগজ কী করে বের করতে হয়, শিখে গেলাম। তারা-তেও একই কাণ্ড! চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিজের কাজটুকু হাতে-কলমে শেখার সুযোগ পাচ্ছিলাম। প্রথম শুটিং-এর সময় অনেকটা নার্ভাস ছিলাম, এখন আর যেটা লাগে না। ঋতুদা অফিস ছেড়ে দিলেও তখনও ‘বস’ বলেই মানি। ভাবলাম তারা-র পুজো প্রোমোটা নিয়ে একটু কথা বলে আসি। আর তিতলি-র গানটা কমপ্লিট। সেটা তো জমা দেওয়ার কথা আছেই। গুনগুন করতে করতে ঋতুদার বাড়ি হাজির হলাম। ঘরে তখন অন্য সব লোক। ঋতুদা বসতে বলল গদিতে, আমি ইশারায় জানালাম গানটা হয়ে গেছে। লোকজন একটু ফাঁকা হতেই বললাম, ‘গানটা শুনবে?’ ঋতুদার গলায় যেন অনেক নিরাসক্তি– ‘শোনা।’
চোখ বুজে প্রাণপণে গাইলাম, শেষ হল গান একসময়। ঋতুদার মুখে-চোখে কী একটা অস্বস্তি, খুশি না অখুশি, বুঝছি না ঠিক।
–পছন্দ হয়নি?
–ভালো গান হয়েছে। শোন না, একটা কাণ্ড করেছি। আমি নিজেই একটা লিরিক লিখে ফেলেছি। শুনবি একবার?
আশাভঙ্গের যে কোনও সিচুয়েশনে কাচ ভাঙার শব্দ দেওয়া হয়। মেঘপিওনকে আমার গলা টিপে দিতে ইচ্ছে করছিল, আর বুক জুড়ে উড়ছিল মনখারাপের দিস্তে কাগজ।
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?
খেলিফের প্রতি নেটিজেনের বিরুদ্ধতার কারণ তাই, আর যাই হোক, তা ‘মেয়েদের সমানাধিকারের’ দাবিতে নয়। সমস্যা অবশ্যই খেলিফের লম্বা, পেটানো পেশিবহুল চেহারা– যা বহু মানুষের মতে ‘নারীসুলভ’ নয়। অর্থাৎ, অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ক্রীড়াবিদ পাশ করতে পারেননি আমাদের বিউটি প্যাজেন্টে। দুইক্ষেত্রেই লজ্জা আমাদের। তবুও খেলিফ জিতলেন, সোনা ছাড়া আর কীই বা পেতে পারতেন তিনি?