বইয়ের নাম ‘দ্য ভিশনারিস্’। লিখেছেন জার্মান দার্শনিক ওলফ্রাম আইলেনবার্গার। বেশ কিছু চেনা পথ ও ঠিকানা গুলিয়ে দিচ্ছে। এই বয়সেও আমাকে শিকড়ে-বাকড়ে উপড়ে ফেলেছে। বুকের শিরা ছিঁড়ে দিচ্ছে। প্রত্যয়ের গোড়ায় শাবল মারছে। এমন বই যে কোন কাঠে তৈরি, কেমন টেবিলে বসে ভাবা যায়, লেখা যায়, জানি না। এমন বই আগে পড়িনি, নিশ্চিত আমি।
৪৬.
জার্মান দার্শনিক ওলফ্রাম আইলেনবার্গারের ‘দ্য ভিশনারিস’ বইটা শন হোয়াইটসাইডের ইংরেজি অনুবাদে, পেঙ্গুইনের প্রকাশনায়, আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে মাসখানেক হল। এবং সহজে নামবে না। এই বয়সেও আমাকে শিকড়ে-বাকড়ে উপড়ে ফেলেছে। বুকের শিরা ছিঁড়ে দিচ্ছে। প্রত্যয়ের গোড়ায় শাবল মারছে। বেশ কিছু চেনা পথ ও ঠিকানা গুলিয়ে দিচ্ছে। এমন বই যে কোন কাঠে তৈরি, কেমন টেবিলে বসে ভাবা যায়, লেখা যায়, জানি না। এমন বই আগে পড়িনি, নিশ্চিত আমি।
আইলেনবারগার আধুনিক পৃথিবীর চার আন্তর্জাতিক খ্যাতির চিন্তকের অন্তর্মহলের দরজা খুলে দিচ্ছেন। তার মধ্যে শুধু দু’জনকে নিয়ে এবারের কাঠখোদাই। অ্যাকাডেমিক কচকচানি নেই, আছে রসালো গল্প; অথচ এই যুগের এমন সব ভাবনা-চিন্তা, যা না-জানা অপরাধ। যেমন ধরুন, বিখ্যাত দার্শনিক ও লেখক সার্ত্রের দৈত্যের মতো যৌন খিদের তাড়না। বইয়ের একটা পুরো চ্যাপ্টার এই বিষয় নিয়ে:
‘Particularly because during this early phase of the return to Paris, Sartre began to reveal– and satisfy the full extent of his gigantic sexual appetite. His many and varied trysts ate deeper and deeper into his Paris timetable. He barely had time to meet Beauvoir for a coffee at Le Dome or even at the station, to hand her the latest manuscript pages of his novel in progress, Melancholia.’
কোনও আড়াল করার ব্যাপার নেই। সার্ত্রে প্যারিসে ফিরেই প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর দৈত্যাকার যৌন খিদে মেটানোর অভিসারে। এই যৌন খিদে তিনি পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতে লাগলেন। কোনওরকম লুকোচুরি করেননি, আমরা বাঙালিরা যেমন আধ্যাত্মিকতার পর্দা টেনে সেক্সের তাড়না আড়াল করি। তবে এত নারীকে প্রতিদিন প্রয়োজন হত যে, তাঁর টাইমটেবিল সামলানো দায় হল। যাঁর সঙ্গে সহবাস করছেন সেই সিমোন-এর সঙ্গে কফি খাওয়ার সময় নেই তাঁর। এমনকী, স্টেশনে দেখা করে ‘মেলানকোলিয়া’ নামে যে উপন্যাসটি লিখছেন তার পাণ্ডুলিপির কয়েকটি পাতাও পৌঁছে দিতে অপারগ তিনি। কারণ যে যুবতী তখন তাঁকে সবথেকে বেশি গিলে খাচ্ছে সে ওলগা, সিমোনের বন্ধু। সম্পর্কের এই দারুণ দহনের ত্রিভুজ, তা-ও লুকিয়ে রাখেননি সার্ত্রে। লুকোচুরি তাঁর ধাতে সয় না।
এইবার আইলেনবার্গার আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন এমন এক ভূমিতে যেখানে দেবদূতও পা ফেলতে ভয় পায়। ওলগার সঙ্গে সার্ত্রের এই সম্পর্ক কী চোখে দেখছেন সহবাসিনী সিমোন? নিজে জানাচ্ছেন সিমোন, কোনও আবেগপ্রবণ ন্যাকামি না করে:
‘Olga was furiously skeptical concerning all interpretations, which by itself was not enough to unsettle me; but in the face of her opposition, Satre too let himself go, to the great detriment of his emotional stability, and experienced feelings of alarm, frenzy and ecstasy such as he has never known with me. The agony which this produced in me went far beyond mere jealousy: at times I asked myself whether the whole of my happiness did not rest upon a gigantic lie.’
সিমোন এক অসাধারণ নারী। এবং অসাধারণ ভাষায় তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর দহন ও ঈর্ষা। তিনি অন্তরে জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছেন। অথচ এক ত্রিভুজ সম্পর্কের অন্তর্কথাটি তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। পাতি বাংলায় সিমোনের শিক্ষিত ইউরোপিয়ান মনের কথা এবার অনুবাদের চেষ্টা করছি:
আমাদের মাঝখানে হঠাৎ এসে পড়ল ওলগা। জড়িয়ে গেল আমাদের দু’জনের সম্পর্কে তৃতীয় জন। তার তো একটা ব্যাখ্যা থাকবে। ওলগা আমাদের মধ্যে এল কীভাবে? সমস্যা হল, সমস্ত ব্যাখ্যাকেই প্রচণ্ড সন্দেহের চোখে দেখে ক্রমাগত উড়িয়ে দিয়ে ওলগা ধুলোর ঝড় তুলল। তাতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু আমার মনে হল, সার্ত্রে নিজেও সেই ধুলোর ঝড়ে আরও অস্পষ্টতা যোগ করল। সার্ত্রে ভাবের ঘরে চুরি করছে, এই মিথ্যাচার আমাকে সবথেকে বেশি কষ্ট দিয়েছে।
আরও একটা পরিবর্তন আমাকে খুব বেদনা দিয়েছে। আমি চোখের সামনে দেখতে লাগলাম আমার চেনা মানুষটার ভিতরের দুর্বলতা। সার্ত্রে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে তার আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ। অজানা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করছে। এমন খ্যাপামি তার মধ্যে আগে দেখিনি। আবার এমন তুমুল আনন্দ, তা-ই বা আসছে কোথা থেকে। এই মানুষটাকে আমি চিনি না। ওলগা ওকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে? আর সার্ত্রে ভেসে যাচ্ছে কেন? আমার আসল যন্ত্রণা সেখানে। ভাববেন না, আমি প্রেমের সাধারণ ঈর্ষার কথা বলছি। একেবারেই সেটা নয়। মাঝেমাঝে এই অবস্থাটা আমাকে দাঁড় করাচ্ছে আরও অনেক গম্ভীর প্রশ্নের সামনে। আমি কি আমার সমস্ত জীবনের সমস্ত আনন্দকে শেষ পর্যন্ত ভুল করে প্রতিষ্ঠিত করেছি একটা বিপুল মিথ্যার ওপর?
ওলগা, সিমোন আর সার্ত্রের জীবনে এসে পাগলামি আর দহন, পুরুষের দৈত্যের মতন যৌন খিদে আর নারীর জ্বলন্ত ঈর্ষা তৈরি করার আগে কেমন ছিল সার্ত্রে আর সিমোনের জীবন? জানিয়েছেন আইলেনবার্গার:
‘For years Beauvoir and Sartre had lived together, not in apartments, but in hotels on the Left Bank. It was there that they danced and laughed, cooked and drank, argued and slept together. Without any external compulsion, without any hard-and-fast rules, and above all, as far as possible, without making false promises and renunciations. Might a mere glance, a casual touch, light the flame of life renewed once more?’
বছরের পর বছর সার্ত্রে আর সিমোন প্যারিসের লেফট ব্যাঙ্কে সহবাস করেছেন। কিন্তু কোনও অ্যাপার্টমেন্টে নয়। ওঁরা থাকতেন হোটেল-ঘরে। একই ঘরের মধ্যে স্নান, মলত্যাগ, রান্না, শোয়া। তাতেই আনন্দ। নাচছেন। লিখছেন। তর্ক করছেন। বিছানায় যাচ্ছেন। প্রতিটি মুহূর্ত যেন আগুনের ফুলকি। হৃদয় যা চাইছে, তা-ই করছেন। কারওর আদেশ পালন করতে হচ্ছে না। এই জীবনের মধ্যে একে একে নতুন মেয়েদের তো নিয়ে এলেন সিমোন নিজে, স্বাধীন জীবন ও ভাবনার স্বাদ দিতে? সেই সঙ্গে সিমোন কি এই নতুন মেয়েদের প্যারিসের নষ্টামির স্বাদও দিতে চাননি? লেখার টেবিলকে এই প্রশ্ন করেছেন আইলেনবারগার। এবং উত্তর দিয়েছে লেখার টেবিল। নষ্টামির সেই উত্তর জানতে পড়তেই হবে ‘দ্য ভিশনারিস্’।
আইলেনবার্গার এই কথাটি অবশ্য স্পষ্ট জানিয়েছেন, সিমোনের মা কোনও দিন সিমোনের প্যারিসের ঘরে পা ফেলেননি কোনও খারাপ অসুখের ছোঁয়াচ লাগার ভয়ে। আর বাবা তো মেয়ের মুখের ওপর বলেছিলেন, তুই কোনও দিন বুড়ি বেশ্যার বেশি কিছু হতে পারবি না!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৪৫: ফ্রেডরিক ফোরসাইথকে ফকির থেকে রাজা করেছিল অপরাধের পৃথিবী
পর্ব ৪৪: আম-বাঙালি যেভাবে আমকে বোঝে, দুই আমেরিকান লেখিকা সেভাবেই বুঝতে চেয়েছেন
পর্ব ৪৩: দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে মা দৌড়ে বেরিয়ে গেল, ইবতিসম্-এর উপন্যাসের শুরু এমনই আকস্মিক
পর্ব ৪২: অন্ধকার ভারতে যে সিঁড়িটেবিলের সান্নিধ্যে রামমোহন রায় মুক্তিসূর্য দেখেছিলেন
পর্ব ৪১: বানু মুশতাকের টেবিল ল্যাম্পটির আলো পড়েছে মুসলমান মেয়েদের একাকিত্বের হৃদয়ে
পর্ব ৪০: গোয়েটের ভালোবাসার চিঠিই বাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের সুইসাইড প্রবণতা
পর্ব ৩৯: লেখার টেবিল বাঙালির লাজ ভেঙে পর্নোগ্রাফিও লিখিয়েছে
পর্ব ৩৮: বঙ্গীয় সমাজে বোভেয়ার ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর ভাবনার বিচ্ছুরণ কতটুকু?
পর্ব ৩৭: ভক্তদের স্তাবকতাই পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র-কীর্তি স্থায়ী হতে দেয়নি, মনে করতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী
পর্ব ৩৬: একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে মারিও ভার্গাস লোসা যেন ছবি বিশ্বাস!
পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি
পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল