নারায়ণ সান্যালের বইয়ের সব অদ্ভুততর নাম। বিশ্বাসঘাতক, প্রবঞ্চক, না-মানুষ, রাস্কেল– আরও কত সব। দে’জ-এর কাউন্টারে এসে পাঠকদের বলতে শুনেছি, ‘একটা বিশ্বাসঘাতক নারায়ণ সান্যাল দিন’ বা ‘প্রবঞ্চক নারায়ণ সান্যাল দিন’। লেখক সম্পর্কে এহেন উক্তি শুনে খানিক বিব্রতই বোধ করতাম। এহেন নারায়ণ সান্যাল নিয়ে এক পর্বে লিখলে পাঠকের সঙ্গে ‘প্রবঞ্চনা’ বা ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ই করা হবে। তাই দ্বিতীয় পর্বর জন্য অপেক্ষা করুন।
৪১.
সেটা ১৯৭৮-’৭৯ সাল হবে, একদিন কেউ এসে বলল যে নারায়ণ সান্যাল না কি কলেজ স্ট্রিটে বেঙ্গল পাবলিশার্সের ঘরে এসেছেন। তখন বেঙ্গল পাবলিশার্সে মনোজ বসু খুব একটা আসতেন না– সেকথা আগেও বলেছি। তাঁর ছেলে ময়ূখ বসুই প্রকাশনার কাজ দেখতেন। নারায়ণ সান্যাল ময়ূখদার কাছেই কোনও কাজে এসেছিলেন। যেহেতু ময়ূখদার সঙ্গে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল, তাই বিনা আমন্ত্রণেই আমি সেদিন বেঙ্গলের ঘরে গিয়ে নারায়ণ সান্যালের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে অনুরোধ করি একবার আমাদের দোকানে আসতে।
দে’জ পাবলিশিং শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই নারায়ণ সান্যাল বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখকদের একজন। দেব সাহিত্য কুটীর, আনন্দধারা, রবীন্দ্র লাইব্রেরী, বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে শুরু করে বহু প্রকাশক সেসময় তাঁর বই ছাপতেন। আবার বিশ্ববাণী থেকেও বেশ কিছু বই বেরিয়েছিল। তাঁর কোন-কোন বই বিশ্ববাণী থেকে বেরিয়েছিল আজ আর তা মনে নেই। কিন্তু বিশ্ববাণীর সূত্রে তিনি কখনও-সখনও দে বুক স্টোরেও আসতেন বলে শুনেছি। তবে আমার সঙ্গে সেসময় তাঁর দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ে না।
সেই যে বেঙ্গল পাবলিশার্সে গিয়ে অনুরোধ করলাম আমাদের দোকানে আসতে– সেই থেকে শুরু। তারপর নানা সময়ে তিনি বহুবার দে’জ পাবলিশিং-এ এসেছেন। কিছুদিন আগে আমাদের প্রকাশনার নববর্ষের অনুষ্ঠানের পুরনো বেশ কিছু ছবির মধ্যে নারায়ণদারও অনেক ছবি দেখলাম। তিনি প্রায় প্রতি বছরই নববর্ষের দিন আসতেন। দে’জ পাবলিশিং-এর নববর্ষ উদ্যাপন নিয়ে আগেই বিস্তারে লিখেছি। ১৯৮১ সালে দে’জ-এর কাউন্টারটির নবরূপায়ণের সময় নারায়ণদার পরামর্শে কাজ হয়েছিল সেকথাও বলেছি। লেখক নারায়ণ সান্যাল যে পেশায় একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ বাস্তুকার, তা আমার তখন জানা ছিল না। সম্ভবত বুদ্ধদেবদা (বুদ্ধদেব গুহ) আমাকে নারায়ণ সান্যালের এই পরিচয়ের কথা প্রথম জানিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি বুদ্ধদেব গুহ এবং নারায়ণ সান্যালের মধ্যে খুবই প্রীতির সম্পর্ক ছিল।
১৯৮১ সালের পয়লা বৈশাখের সকালে দে’জ পাবলিশিং-এর কাউন্টার যখন নারায়ণ সান্যালের নকশায় নতুন করে সেজে উঠল তখনও কিন্তু দে’জ থেকে তাঁর কোনও বই প্রকাশিত হয়নি। তবে বইয়ের কাজ ততদিনে শুরু হয়ে গেছে। সেই বছরই জুন থেকে অগাস্টের মধ্যে নারায়ণদার চার-চারটে বই প্রকাশিত হয়– ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘পাষণ্ড পণ্ডিত’, ‘নাগচম্পা’, ‘অন্তর্লীনা’ আর ‘গজমুক্তা’। বইগুলো নতুন নয়, আগে অন্য প্রকাশকের ঘর থেকে বেরিয়েছিল, আমরা রি-প্রিন্ট করেছিলাম। এখন আর নিশ্চিত করে বলতে পারব না, তবে যতদূর মনে পড়ছে– ‘অন্তর্লীনা’, ‘পাষণ্ড পণ্ডিত’, ‘গজমুক্তা’ বোধহয় রবীন্দ্র লাইব্রেরীর বই ছিল; আর ‘বিশ্বাসঘাতক’ সম্ভবত বিশ্ববাণীর।
‘পাষণ্ড পণ্ডিত’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। উপন্যাসটির উৎসর্গের পাতায় চোখ রাখলে লেখকের জীবনের একটি অধ্যায় পড়তে পারা যায়। ওই পাতায় তিনি লিখেছেন, ‘আসানসোলের ই. আই. আর স্কুলের/ যে দু’জন মাস্টারমশাইকে এ বইটি হাতে করে দিতে পারলাম না :/ ৺ হরিদাস গোস্বামী, বি. এ., বি. টি., বি. এল./ পণ্ডিত নন্দলাল রায়, বি. এ. কাব্যতীর্থ/ শ্রদ্ধাবিনম্র/ নারায়ণ সান্যাল’।
নারায়ণদা নিজেকে মজা করে বলতেন ‘কৃষ্ণকলি’– মানে যাদের আদিনিবাস কৃষ্ণনগরে কিন্তু কাজকর্মের সূত্রে কলকাতায় বাস। দেশের বাড়ি কৃষ্ণনগরে হলেও, নারায়ণ সান্যালের জন্ম কিন্তু কলকাতাতেই। ‘কৃষ্ণকলি’ কথাটি পরের দিকে সুধীর চক্রবর্তীর লেখাতেও পড়েছি। নারায়ণদা প্রথমে কলকাতার হিন্দু স্কুলের ছাত্র ছিলেন, পরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন আসানসোলের ই. আই. আর স্কুল থেকে। তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স আর কৃষ্ণনগর কলেজ হয়ে, ১৯৪৮ সালে শিবপুর বি. ই. কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। শিবপুরে তাঁর সহপাঠী ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব বাদল সরকার। ‘পুরোনো কাসুন্দি’র ‘প্রথম পর্যায়’-এ বাদল সরকার লিখেছেন–
‘নারায়ণ সান্যালের সঙ্গে আলাপ সেকেন্ড ইয়ারেই। তখনকার দিনে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথামেটিক্স নিয়ে বি.এসসি পরীক্ষা দিয়ে এলে সেকেন্ড ইয়ারে সরাসরি ভর্তি হওয়া যেত, নারায়ণ তাই করেছিল। দীর্ঘদেহ নারায়ণ, ব্যারাকের ফ্রেশার্স গ্যাদারিঙের দিন গায়ের খদ্দরের চাদরটা ঝটকা মেরে কাঁধে জড়িয়ে একটানা ‘দেবতার গ্রাস’ আবৃত্তি করে যাওয়া এখনও মনে আছে। ঝাড়া মুখস্থ স্বভাবতই, বই দেখে পড়ে যাওয়া সে যুগে রেওয়াজ ছিল না। পরে দেখেছি– নারান ক্রিকেটের ভালো উইকেটকিপার ছিল, তখনই তার কিছু কবিতা ছোটখাটো পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। ভালো অভিনয় করেছে ‘কালিন্দী’ নাটকে অচিন্ত্যবাবুর ভূমিকায়। তার পরবর্তী কীর্তির কথা বাঙালি পাঠকের কাছে সুপরিচিত, আমার বলার অপেক্ষা রাখে না।
সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম পিরিয়ডিক্যাল পরীক্ষা, যার তেমন গুরুত্ব নেই… , নারান আমার কাছে এল তার দু’দিন আগে– শুনছি না কি পরশু থেকে পরীক্ষা ?… বললাম, বসে যা এখানে, কোনো ভাবনা নেই। এক অন্ধ আর এক অন্ধকে পথ দেখাবে, এটা তো সর্বজনস্বীকৃত তত্ত্ব ! একটা অঙ্ক দু’জনে করলাম পাশাপাশি বসে। জিজ্ঞেস করলাম– কত বেরোল তোর উত্তর ? নারান বলল– অনেক। অঙ্কের এমন ‘সদুত্তর’ হতে পারে জানতাম না। পরীক্ষার দিনে তিন বেঞ্চি টপকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল– বাদল, তিন নম্বরের প্রশ্নটা কি ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির? আমি তেমনি চেঁচিয়ে বললাম– না। তবে আর হল না রে– বলে নারান উঠে পড়ল। অধ্যাপক গার্ড চিৎকার শুনেই হাঁ হাঁ করে ছুটে এসেছিলেন, এখন জোর করে নারানকে বসিয়ে দিলেন, এক ঘণ্টার আগে বেরোবার নিয়ম নেই। নারান এক ঘণ্টা গালে হাত দিয়ে বসে কড়িকাঠ শুনল ধৈর্য ধরে, মেয়াদ ফুরোলে বেরিয়ে গেল।’
ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে নারায়ণদা পি. ডব্লিউ. ডি-তে অ্যাসিট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ নেন। তাঁর বাবাও একই পেশায় ছিলেন। স্মৃতিচারণমূলক বই ‘পঞ্চাশোর্ধ্বে’তে নারায়ণ সান্যাল লিখেছেন–
‘…আমার বাবা শিবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৮৯৬ সালে বি. ই. পাস করে বৃহত্তর বেঙ্গল পি. ডাব্লুতে ঢুকেছিলেন গত শতাব্দীর একেবারে শেষাশেষি। তার বছর পঞ্চাশ পরে সে ইতিহাস পুনরভিনীত হয়েছিল আমার জীবনে। বাবাও ছিলেন সিভিল এঞ্জিনিয়ার। ‘বাংলা’ বলতে তখন আসামের খানিকটা, আর বিহার-উড়িষ্যা সমেত। ফলে বদলির কল্যাণে বাবাকে ঘুরতে হত বৃহত্তর ব্যাসার্ধে। যখন যেখানে থাকতেন তাঁকে ঘুরে ঘুরে কাজ দেখতে হত– যাকে আমরা সাদা-বাঙলায় বলি ‘ট্যুরে যেতে হত’। চাকরির আদি যুগে এজন্য তাঁর ছিল একটি ঘোড়া। ‘শৈনগুপ্ত’ তার নাম। বাবা যখন যেখানে বদলি হয়েছেন ঘোড়াও বদলি হয়েছে তাঁর সাথে। সহিসও। বাবার কাছে শুনেছি– এখন যেমন ‘কার-অ্যালাওয়েন্স’ দেওয়া হয়, ওঁদের আমলে ওঁরা তেমনভাবে পেতেন ‘হর্স-অ্যালাওয়েন্স’। অশ্বারোহণের প্রয়োজনে বাবাকে ট্যুরে যেতে হত টাইট ব্রিচেস পরে, ফেল্ট-হ্যাট মাথায়। মায়ের ফটো-অ্যালবামে আঁটো-ব্রিচেস-পরা, ঘোড়ার পিঠে বাবার ছবি দেখা ছিল বাল্যকাল থেকে। শৈশবে, বাল্যে এমন-কি কৈশোরেও স্বপ্ন দেখতাম আমিও বড় হয়ে অমন পোশাক পরব, অমনভাবে ঘোড়ায় চেপে কাজ দেখতে বেরুব। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার– বাবার চেয়ে চাকরির ক্ষেত্রে আমি পঞ্চাশ বছরের জুনিয়র। আমি যখন চাকরি করতে বেঙ্গল পি. ডাব্লুতে ঢুকি তখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে বদলি হওয়ার দুর্লভ সুযোগের সঙ্গে সঙ্গে অশ্বারোহণের যুগটাও গেছে নেপথ্যে। হর্স-অ্যালাওয়েন্স না-পাত্তা। ঘোড়া-সহিসও কর্পূর। অথচ জিপারোহণের যুগ তখনও আসেনি। জিপ ছিল, বড়কর্তাদের জন্য। অ্যাসিস্টেন্ট এঞ্জিনিয়ারদের জন্য নয়। তাহলে চাকরির আদিপর্বে আমরা ট্যুরে যেতাম কী-ভাবে ? দ্বিচক্রযানে। চাকরিতে ঢুকেই কিনেছিলাম ‘হারকিউলিস্’ মার্কা একখানা সাইকেল। হারকিউলিস্ শক্তির প্রতীক।…’
তাঁর বাবার সহিস যেমন ঘোড়াকে রোজ দানাপানি খাইয়ে তৈরি রাখত, সকালে নিয়ম করে দলাই-মালাই করত; নারায়ণদার তখনকার সব কাজের সহায়ক নন্দু থাপা তেমনি সাইকেলের চাকায় পাম্প দিয়ে রাখত, চেনে তেল দিত। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা তো কম বড়ো ছিল না। তিনি ট্যুরে যেতেন সাইকেলে সওয়ার হয়ে। ট্রেনে যতটা যাওয়া যায় গিয়ে, বাকিটা সাইকেলে। ট্রেনের ব্রেকভ্যানে থাকত সাইকেল। রোজ তিরিশ-চল্লিশ মাইল সাইকেলে চড়ে যেতে হত। ইচ্ছে করলে অবশ্য একদিনের ট্যুর দু’-দিনেও করা যেত। কিন্তু তখন তিনি সদ্য বিবাহিত। তাই দ্রুত কাজ মিটিয়ে ঘরে ফেরার টান থাকাটাই স্বাভাবিক। বউদির আপত্তিতে ট্যুরে যাওয়ার পোশাকও বদলে ফেলতে হয়েছিল নারায়ণদাকে। তখন মেদিনীপুরের রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। তাই চাকরিতে ঢুকেই তিনি এক ডজন খাকি হাফ-প্যান্ট বানিয়ে নিয়েছিলেন। নারায়ণদার ভাষায়– ‘পায়ের তলায় হারকিউলিস, পরনে খাকি হাফ-প্যান্ট, ফুল মোজা, মাথায় হ্যাট। কেরিয়ারে নোটবই, মাপবার ফিতে, মৌজা-ম্যাপ, স্কেল, কম্পাস। বলুন ! বীরত্বব্যঞ্জক রণসজ্জা নয় ? প্রাক্বিবাহ জীবনে এই ছিল আমার ট্যুরের সাজ। ‘কিন্তু সব সুখ কি হয় রে দাদা– ?’ অ্যাসিস্টেন্ট এঞ্জিনিয়ারের কোয়ার্টার্সে নতুন ভাগিদার সংসার করতে এসেই কুঞ্চিত-নাসা হলেন, ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘হাফপ্যান্ট ! ওমা ! ও আবার ভদ্রলোকে পরে নাকি ?’
লেখার মতোই রসস্নিগ্ধ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। কলেজ স্ট্রিটে আমাদের দপ্তরে হোক কিংবা তাঁদের চক্রবেড়িয়া রোডের বাড়িতে– তাঁর হাসিমাখা মুখটাই আমার মনে পড়ে।
নারায়ণ সান্যালের লেখালিখির শুরু কিন্তু একটি নাটক দিয়ে– ১৯৫৪ সালে লেখা ‘মুশকিল আসান’ নাটকটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। এর পরের বছর তিনি লেখেন ‘বকুলতলা পি. এল. ক্যাম্প’ এবং ‘বল্মীক’। দু’টি বই-ই বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে বেরিয়েছিল– সাহিত্যজীবনের শুরুর এই দু’টি লেখাই ছিল দেশবিভাগোত্তর বাংলার ছিন্নমূল, ‘পার্মানেন্ট লায়েবিলিটি’ নামে চিহ্নিত মানুষের জীবনযন্ত্রণার দলিল। চাকরিজীবনের সূচনায় উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিভাগে কিছুদিন কাজ করায় এই সব মানুষকে নিয়ে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। তাই বই দু’টি আজও বাংলার সেকালীন উদ্বাস্তু জীবনের বহুমুখী টানা-পোড়েনের শৈল্পিক প্রকাশ হিসেবে সমাদৃত। ‘বল্মীক’ বেরোনোর পর সেই কাহিনি অবলম্বনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচার বিভাগ ১৯৫৭ সালে ১৫ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। ছবিটির পটভূমিতে ছিল নদিয়ার গয়েশপুর উদ্বাস্তু কলোনি। এই ছবিতে নারায়ণদা জীবনে প্রথমবার রুপোলি পর্দায় অভিনয় করেন। ‘বকুলতলা পি. এল. ক্যাম্প’, ‘বল্মীক’, ‘দণ্ডক-উপনিবেশ– আদি পর্ব’, ‘দণ্ডক-উপনিবেশ– অন্ত পর্ব’, ‘ছয়তানের ছাওয়াল’, ‘লৌকিক না অলৌকিক’, ‘সন্তান মোর মার’ এবং ‘আয়ারল্যান্ড নিরাশীবিষ’– এই লেখাগুলি নিয়ে আমি ২০০০ সালে দে’জ পাবলিশিং থেকে ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করি। বইটির নাম ‘সোনার বাংলা’ রাখার পিছনে সাহিত্যিক কারণ যেমন আছে, তেমনই একটি ব্যক্তিগত অনুষঙ্গের কথাও লেখক আমাদের শুনিয়েছেন এই বইয়ের ‘কৈফিয়ত’-এ–
‘বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে– অর্থাৎ আমার বাল্যকাল থেকে কৈশোরে উত্তরণের যুগে– বাবামশাইকে (চিত্তসুখ সান্যাল– 1871-1946) দেখতাম সাদা বাঙলায় কীসব হাবিজাবি লিখে চলেছেন, কখনও বা প্রুফ সংশোধন করছেন। একটু বড় হয়ে শুনলাম তিনি যৌথ-সম্পাদনায় একটি মাসিকপত্র প্রকাশ করেন। অপর সম্পাদক বাবার বাল্যবন্ধু রায়বাহাদুর গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তার অপরজন সিভিল এঞ্জিনিয়ার। দুই বন্ধু স্বগৃহে আহারান্তে নিজ নিজ ব্যয়ে বন্যমহিষ বিতাড়নে ব্রতী। ওঁরা সৃষ্টি করেছিলেন ‘অ্যান্টিম্যালেরিয়াল সোসাইটি’: সোনার বাঙলা থেকে ম্যালেরিয়া ব্যাধিকে নির্মূল করার প্রয়াসে। পত্রিকাটির নাম ছিল: সোনার বাঙলা।
সুতরাং ওই নামটির সঙ্গে আমার বাল্যস্মৃতি বিজড়িত।…’
নারায়ণদা গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গের পূর্ত বিভাগ থেকে ডেপুটেশনে গিয়েছিলেন দণ্ডকারণ্যে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজে। সেই সময় তিনি আদিবাসীদের নিয়ে লেখেন– ‘দণ্ডক-শবরী’। লেখার পর তিনি পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রকাশক মনোজ বসুকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার জন্য। মনোজ বসু সেটি ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষকে পড়তে দেন এবং সাগরদা সেখানে থেকে কিছু লেখা ‘নৈমিষারণ্যের ডাক’ নামে ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপেন। এই ধারাবাহিকের লেখকের নাম অবশ্য নারায়ণ সান্যাল ছিল না। ‘নৈমিষারণ্যের ডাক’-এ লেখকের নামের জায়গায় ছাপা হত নারায়ণদার ছদ্মনাম ‘বিকর্ণ’। দে’জ থেকে আমি সুধীর মৈত্র-র প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছি ১৯৯৫ সালে। তার অনেক আগেই গৌতম রায়ের প্রচ্ছদে ১৯৮৪ সালে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে দণ্ডকারণ্য পর্বে লেখা তাঁর অন্য বই ‘অরণ্যদণ্ডক’। এখনকার সংস্করণে অবশ্য লেখকের নিজের আঁকা প্রচ্ছদই ব্যবহৃত হয়।
পরপর নারায়ণদার বই পুনর্মুদ্রণ করে গেলেও, দে’জ পাবলিশিংকে তিনি নতুন বইও দিতে শুরু করেছিলেন অল্প দিনের মধ্যেই। সেই সময় থেকেই আমি নারায়ণদার লেখার বিষয়বস্তুর বিপুল বৈচিত্র টের পাই। কোনও একটা বা দু’-তিনটে বিষয়ে তাঁকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। নারায়ণদা তাঁর প্রতিটি বইয়ের শুরুতে নিজের লেখা বইগুলির যে তালিকা দিতেন, তাতে বইয়ের বর্গীকরণ করতে গিয়ে তিনি A থেকে R পর্যন্ত আঠারোটি ভাগ করেছেন। সেখানে যুক্তাক্ষর বর্জিত শিশুসাহিত্য থেকে প্রযুক্তি, শিল্পকলা, সামাজিক উপন্যাস, অরিগামি– কী নেই ! সম্ভবত এখন আমরা নারায়ণদার সবচেয়ে বেশি বইয়ের প্রকাশক। তাই তাঁর প্রায় সব বইয়ের সঙ্গেই আমার খানিকটা পরিচয় তো আছেই। বিষয়বৈচিত্রের কথাটা এজন্যই তুললাম। আমি যেমন ‘নাকউঁচু’, ‘কডুরয় ও খুকু-মা’ ছেপেছি– তেমনই ‘রূপমঞ্জরী’র তিনটি খণ্ডও ছেপেছি।
১৯৮৪ সালের পয়লা বৈশাখে আমি নারায়ণ সান্যালের দু’টি নতুন বই ছেপেছিলাম– ‘না-মানুষের পাঁচালী’ আর ‘রোদ্যাঁ’। ‘না-মানুষের পাঁচালী’ বইয়ের ‘কৈফিয়ত’-এ তিনি জানিয়েছেন–
‘কাহিনীগুলির ‘আমি’ কিন্তু বর্তমান লেখক নন। বিভিন্ন ‘না-মানুষ-প্রিয়’ মানুষের ভূমিকায় ‘আমি’ অভিনয় করে গেছেন।
‘না-মানুষের কাহিনী’, ‘পদ্মপত্রবিহারিণী’ এবং ‘পিতৃত্বের দায়’– এর ‘আমি’ হচ্ছেন জেরাল্ড ডারেল (Gerald Durrell)। তাঁর ‘Encounters with Animals’ এবং অন্যান্য বই থেকে গল্পের মূল কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যদিও নানান জীববিজ্ঞানের গ্রন্থ থেকে আরও তথ্য যুক্ত করেছি। এক সময় টাইমস্ লিটারারি সাপ্লিমেন্ট এঁর সম্বন্ধে বলেছিল, ‘If animals, birds and insects could speak, they would possibly award Mr G. Durrell one of their first Nobel Prizes.’
‘পেটুক’ গল্পের ‘আমি’ হচ্ছেন ডি লরেন্স। তাঁর মূল কাহিনীটির নাম– ‘Paddy : A Naturalist’s Story of an Orphan Beaver’.
কোন কাহিনীই অনুবাদ করিনি, কাহিনীগুলি অবলম্বনে বঙ্গভাষাভাষী পাঠকের উপযুক্ত করে পরিবেশনের চেষ্টা করেছি।…’
সেই বছরই ডিসেম্বরে তিনি লিখলেন– ‘রাস্কেল’। ‘রাস্কেল’ বইটি তিনি ‘না-মানুষের পাঁচালী’ সিরিজের দ্বিতীয় বই হিসেবে লিখেছিলেন। এর ছ-বছর পরে নারায়ণদার আরেকটি নতুন বই আমি প্রকাশ করি– ‘না-মানুষের কাহিনী’। বইটিতে ছিল মোট ন-খানি গল্প– যার ‘অধিকাংশ গল্পের প্লট বিদেশী কাহিনী থেকে ধার নেওয়া’। এর আগে অবশ্য ১৯৮৮-তে প্রকাশিত হয়েছে ‘না-মানুষী বিশ্বকোষ’-এর প্রথম খণ্ড এবং ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় খণ্ড। ‘না-মানুষী বিশ্বকোষ’-এর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের পর আমি দে’জের পক্ষ থেকে একটি ‘নিউজ লেটার’ প্রকাশ করে সেই সঙ্গে দু’-টি খণ্ডের খানিকটা করে অফ-প্রিন্ট কলকাতার কিছু বিশিষ্ট পাঠক, শহর ও জেলা-মফস্সলের পুস্তক বিক্রেতা এবং রাজ্যের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে পাঠিয়েছিলাম। ২২ জুলাই ১৯৯১ তারিখ দেওয়া সেই চিঠিতে লেখা হয়েছিল–
‘সবিনয় নিবেদন,
আমার এই পত্রটি ‘বিজ্ঞাপন’ নয়; বিদগ্ধজনকে বিশেষভাবে জ্ঞাপন করার প্রেরণাটা যদিও অনস্বীকার্য। একটি ‘ট্রিলজি’ গ্রন্থমালার দ্বিতীয় খণ্ডটি আমরা সম্প্রতি প্রকাশ করেছি, এই বার্তাটা আপনার সমীপে পেশ করতে চাই। গ্রন্থটি:
নারায়ণ সান্যাল লিখিত না-মানুষী ‘বিশ্বকোষ’-এর দ্বিতীয় খণ্ড।
‘না-মানুষ’ অর্থে যাদের প্রাণ আছে, অথচ যারা মানুষ নয়। সে হিসাবে গাছেরাও ‘না-মানুষ’। এক-কোষী উদ্ভিদ থেকে প্রায়-মানব (হোমো-ইরেক্টাস) পর্যন্ত যাবতীয় প্রাণবস্তু জীবের আবির্ভাব, বিবর্তন, শ্রেণী, বর্গ-বিন্যাস ও প্রজাতির বিচিত্র বিবরণ। জীববিজ্ঞানের ‘সিলেবাস’-এর বাইরেও যে বিষয়টি আকর্ষণীয় হতে পারে তার প্রমাণ এ গ্রন্থ। সমগ্র প্রয়াসটি তিনটি খণ্ডে বিধৃত।
প্রথম খণ্ড : উদ্ভিদ ও অমেরুদণ্ডীপ্রাণী : বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্বের ফাঁকে-ফাঁকে অনবদ্য সচিত্র কাহিনী– শিকারের নয়, স্বীকারের। ‘বড়দা’ হিসাবে যে অপরাধ মানুষ করে চলেছে সেই অপরাধের। সাইজ, 256 পৃষ্ঠা, ডবল কলম, প্রায় চারশত ছবি। মূল্য: Rs. 100/-
দ্বিতীয় খণ্ড : মেরুদণ্ডী-পর্যায় : মাছ থেকে পাখি; গাছ [মাছ ?], উভচর, সরীসৃপ ও পাখির আলোচনা, সর্বসমেত প্রায় তিনশত প্রজাতির পরিচয়। সাইজ, 236 পৃষ্ঠা, ডবল কলম, প্রায় ছয়শত রঙিন ও শাদাকালো ছবি। মূল্য: Rs. 120/-
তৃতীয় খণ্ড: মেরুদণ্ডী-পর্যায় : স্তন্যপায়ী প্রস্তুতির পথে।
বাংলা-সাহিত্যে এ প্রচেষ্টা অতুলনীয় এবং অভূতপূর্ব কিনা সে-কথা আপনারা বলবেন।
বিজ্ঞাপনের প্রচলিত ‘সুপারলেটিভ’ বিশেষণ পরিহার করতে পি. টি. এস পদ্ধতিতে ছাপা গ্রন্থদ্বয়ের কিছু নমুনা এই সঙ্গে পাঠালাম।
বিনয়াবনত
সুধাংশুশেখর দে’
আমাদের প্রকাশনায় পি. টি. এস-এ ছাপা এটাই প্রথম বই হয়তো নয়, কিন্তু পি. টি. এস-এ আমাদের প্রথমদিকের একটা কাজ তো বটেই। তবে দুঃখের বিষয় নারায়ণদা ‘না-মানুষী বিশ্বকোষ’-এর তৃতীয় খণ্ডটি লিখে যেতে পারেননি।
না-মানুষী পর্বের অনেক আগে, সেই ১৯৮৩ সালে, দে’জ থেকে একসঙ্গে নারায়ণ সান্যালের তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছিল– ‘নীলিমায় নীল’, ‘পথের মহাপ্রস্থান’ এবং ‘কুলের কাঁটা’। ‘কুলের কাঁটা’ তাঁর ‘কাঁটা সিরিজে’র পাঁচ নম্বর বই। যদিও নারায়ণ সান্যাল মনে করতেন কাঁটা সিরিজের আদি লেখাটি (তাঁর ভাষায় ‘ট্রায়াল বল’) হল ‘নাগচম্পা’– কেননা এই উপন্যাসেই ব্যারিস্টার পি কে বাসুর আবির্ভাব।
‘নাগচম্পা’ উপন্যাস নিয়ে ‘যদি জানতেম’ নামে ১৯৭৪ সালে ‘যাত্রিক’-এর পরিচালনায় একটি সফল চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছিল। শুরুতে ‘যাত্রিক’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার, শচীন মুখোপাধ্যায় এবং দিলীপ মুখোপাধ্যায়। ‘যাত্রিক’-এর প্রথম ছবি মুক্তি পায় ১৯৫৯-এ– উত্তমসুচিত্রা জুটির ‘চাওয়া-পাওয়া’। পরে তরুণ মজুমদার এবং শচীন মুখোপাধ্যায় ‘যাত্রিক’ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও দিলীপ মুখোপাধ্যায় বেশ কিছুদিন ‘যাত্রিক’ নামেই ছবি পরিচালনা করেছিলেন। আমার মনে হয় ‘যদি জানতেম’ দিলীপ মুখোপাধ্যায়েরই বানানো। আর সে ছবিও ছিল তারকাখচিত– উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া চৌধুরী, বসন্ত চৌধুরী, রুমা গুহঠাকুরতা, শমিত ভঞ্জ– বাংলা সিনেমার শ্রেষ্ঠ কলাকুশলীরা ছিলেন ‘যদি জানতেম’ ছবিতে।
‘নাগচম্পা’র পরেই নারায়ণদার মনে পি কে বাসুকে নিয়ে নানা রকম গোয়েন্দা কাহিনি লেখার ইচ্ছে জন্মায়। তবে তিনি মুক্তকণ্ঠে তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা গল্পে বিদেশি সাহিত্যের গোয়েন্দাদের প্রভাবের কথা স্বীকারও করেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ চরিত্রটিকে সৃষ্টি করেছিলেন স্যার আর্থার কনান ডয়েল-এর বিশ্ববিশ্রুত গোয়েন্দা শার্লক হোমস-এর ছায়া দিয়ে’। নিজের ‘সোনার কাঁটা’ সম্পর্কে নারায়ণদা যেমন লিখেছেন– ‘ক্রিস্টি-কীর্তি ‘মাউস ট্র্যাপ’-এর ছায়া দিয়ে গড়া’। আবার এও বলেছেন, ‘… শরদিন্দুবাবুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি একটি বিদেশি গোয়েন্দাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি বাংলা সাহিত্যে– যে চরিত্রটি স্ট্যানলি গার্ডনার-সৃষ্ট চরিত প্যেরী মেসন ‘বার-অ্যাট-ল’ ’। নারায়ণদা ‘সোনার কাঁটা’ বইটি ৺ব্যোমকেশ বক্সীকে উৎসর্গ করা। সে-বইয়ের উৎসর্গপত্রটি ছিল একেবারে অন্য রকমের– ‘পরম শ্রদ্ধেয় অগ্রজপ্রতিম
ব্যোমকেশ বক্সী মশাই,
তোমার কীর্তি কাহিনি আমরা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে জেনেছি কয়েক দশক ধরে। গোয়েন্দা-কাহিনিকে তুমি ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের সমপর্যায়ে উন্নীত করেছিলে। মৈনাককে তুমি মগ্ন হয়ে থাকতে দাওনি, দুর্গের রহস্য তুমি ভেদ করেছিলে, চিড়িয়াখানার কলকাকলীতে [য.] তুমি বিভ্রান্ত হওনি, শজারুর কাঁটা কার হৃৎপিণ্ডের কোন দিকে বিদ্ধ হচ্ছে তা একমাত্র তোমারই নজরে পড়েছিল। তুমি গোয়েন্দা নও, তুমি ছিলে সত্যান্বেষী ! অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণে তুমি আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেলে চিরদিনের জন্য ! তাই তোমাকেই স্মরণ করছি সর্বাগ্রে।
গ্রন্থকারের তরফে
পি. কে. বাসু, বার-এ্যাট-ল ২।১০।১৯৭৪’
অনেক পরে তাঁর কাঁটা সিরিজের তেইশটি রচনা দে’জ পাবলিশিং থেকে ‘কাঁটায়-কাঁটায়’ শিরোনামে ছ-টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ১৯৯১-এর বইমেলায় প্রথম দু’-টি খণ্ড দিয়ে আমি সিরিজটি চালু করি, ছ-টি খণ্ডের শেষটি প্রকাশিত হয় ২০০৩ বইমেলায়। ইদানীং বোধহয় কোনও ওটিটি-তে ‘কাঁটায়-কাঁটায়’ নিয়ে ওয়েব সিরিজ হচ্ছে। তাই নারায়ণদার এই বইগুলো নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। একই ঘটনা ঘটেছিল ২০২৩-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ওপেনহাইমার’ ছবিটি কলকাতায় আসার পর। এমনিতেই ‘বিশ্বাসঘাতক’ বইটি চিরকালই জনপ্রিয়। কিন্তু এই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর হঠাৎ করেই কিছুদিনের জন্য ‘বিশ্বাসঘাতক’ ফের বেস্টসেলার হয়ে উঠেছিল।
এখানে সাহিত্য ও জনপ্রিয়তা নিয়ে আমাদের কয়েকটা কুসংস্কারের কথা বলতে চাই। বহু বাঙালির এমন ধারণা আছে যে জনপ্রিয় হলে তা সৎ-সাহিত্য হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত আমাদের ভাষার সাহিত্যেই এখনও এরকম ধারণা বলবৎ– সৎ-সাহিত্য বিক্রি হবে না, আর যা বিক্রি হবে সেগুলো কিছুতেই ভালো লেখা হতে পারে না। এই সংকটটা কিন্তু খুব পুরোনো নয়। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়েও বিষয়টা এতটা প্রকট ছিল না। আমার মনে হয় গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে এই রকম ধারণা বাড়তে শুরু করেছে। একজন প্রকাশক হিসেবে আমি সৎ-সাহিত্যেরই বিপণন করতে চাই। আমার ধারণা খারাপ লেখা হাজারও রংচঙে প্যাকেজিংয়ে পাঠকের মন জিততে পারবে না। লেখা এবং লেখকের মুন্সিয়ানাই হল আসল। নারায়ণদার লেখা সেরকমই জনপ্রিয় সৎ-লেখা বলেই আমি মনে করি। এমন বিপুল বিষয়-বৈচিত্র আর সুললিত ভাষার মেলবন্ধনেই নারায়ণ সান্যাল বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকে পরিণত হয়েছেন।
নারায়ণদা যে পেশায় বাস্তুকার সেকথা তো শুরুতেই বললাম। কিন্তু সবাই হয়তো জানেন না আমাদের আর একটি কাজে তাঁর কী ভূমিকা ছিল– ১৯৮৪-৮৫ সাল নাগাদ আমাদের পরিবার এবং আমাদের নিকটাত্মীয় কর পরিবারের সদস্যরা মিলে দীঘায় একটি হোটেল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই হোটেল ‘ব্লু ভিউ’-এর নাম হয়তো আপনারা শুনে থাকবেন। এই হোটেলের আর্কিটেক্ট ছিলেন নারায়ণ সান্যাল। সেই সময় কাজের প্রয়োজনেই তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার দীঘা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি তখন অল্পবয়সে তাঁর দীঘায় কাজ করার দিনগুলোর বহু কথা বলেছিলেন। আমার দেশের বাড়ি যেহেতু দীঘার কাছেই, তাই সাহেবদের দীঘা আবিষ্কার এবং পরে বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে দীঘা সৈকতাবাস তৈরির দিনগুলোর গল্প এবং তাঁর ভাষায় ‘লিভিং স্টোন অফ দীঘা’ স্নেইথ সাহেবের কথাও তিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, দীঘা সৈকতাবাসের তৈরির সময় তার প্ল্যানটাও নারায়ণদাই তৈরি করেছিলেন। দীঘা নিয়ে তিনি বিস্তারে লিখেছেন ‘পঞ্চাশোর্ধ্বে’ বইয়ে। নারায়ণদা কেবল ‘ব্লু ভিউ’-এর নকশাই তৈরি করে দেননি, আমাদের হোটেলের লোগো– মুখোমুখি দুই সি-হর্স, সেটাও তাঁরই এঁকে দেওয়া।
তবে নারায়ণ সান্যালের বইয়ের নামগুলো মাঝে-মাঝে এমন হত যে আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম। যেমন ধরুন– ‘রাস্কেল’, ‘পাষণ্ড পণ্ডিত’, ‘প্রবঞ্চক’। আমার এই অস্বস্তির কথা জানতে পেরে তিনি ‘প্রবঞ্চক’ বইয়ের ‘কৈফিয়ৎ’ অংশে লিখেছেন–
‘বইটির নামকরণ নিয়ে মহা ঝামেলা ভোগ করতে হয়েছে।
সুধাংশু, মানে এ বইয়ের প্রকাশকের প্রবল আপত্তি ছিল নামটাতে। অথচ কেন যে তার আপত্তি সে কথা কিছুতেই স্বীকার করবে না। শেষে “বাবু”, মানে ওর ছোট ভাই, একদিন জনান্তিকে সেটা জানিয়ে দিল আমাকে। বললে, ব্যাপারটা কী জানেন? দাদা তো ওই দূরের টেবিলে বসে কাজ করে, কিন্তু কাউন্টারের কথাবার্তা সবই শুনতে পায়। ক্রেতা এসে যখন আপনার বইগুলো চায়, দাদা মনে মনে গজরায়। খদ্দের হচ্ছে লক্ষ্মী, দাদা ওদের কিছু বলতেও পারে না…
আমি তো বিশ-বাঁও জলে। বলি, কী বলছ মাথামুন্ডু কিছুই বুঝছি না!
–মানে কাউন্টারে এসে ওরা আপনার বইগুলো চায় তো ? শুনতে খারাপ লাগবে না ?
–খারাপ লাগবে ? কেন ?
–আপনি বুঝছেন না। সবারই ঘরে ফেরার তাড়া। সংক্ষেপে হাঁকাড় পাড়ে: ‘আমাকে একখানা বিশ্বাসঘাতক নারায়ণ সান্যাল’, ‘এদিকে একখান না-মানুষ নারায়ণ সান্যাল’, কিংবা ‘রাস্কেল নারায়ণ সান্যাল’ ! শুনতে খারাপ লাগবে না?
তা বটে ! তাই আপনাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ– দে’জ-এর কাউন্টারে এ বইটি কিনতে এলে অনুগ্রহ করে সম্পূর্ণ বাক্যটি বলবেন– ‘নারায়ণ সান্যালের লেখা প্রবঞ্চক দিন’। সংক্ষেপে ‘প্রবঞ্চক, নারায়ণ সান্যাল’ চেয়ে বসবেন না !
আমি বিকর্ণ-দু-কান কাটা-কিন্তু তাতে সুধাংশুর ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যায়।’
লিখন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
…………………… ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর অন্যান্য পর্ব …………………
পর্ব ৪০। সিগারেট ঠোঁটে রথীন্দ্রনাথের ছবি প্রচ্ছদে যাওয়া নিয়ে উঠেছিল প্রবল আপত্তি!
পর্ব ৩৯। শান্তিনিকেতন থেকে কলেজ স্ট্রিট, প্রুফ আদান-প্রদানে সহায়ক ছিলেন বই ব্যবসায়ীরাই
পর্ব ৩৮। পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে সোমেনদা বলেছিলেন, রামকিঙ্করকে নিয়ে এ জাতীয় বই আগে লেখা হয়নি
পর্ব ৩৭। ‘কীর্তির্যস্য’র নাম বদলাতে চেয়েছিলেন ভবতোষ দত্ত
পর্ব ৩৬। কবি-দার্শনিকের বাইরে আরেক রবীন্দ্রনাথকে খুঁড়ে বের করেছিলেন অমিতাভ চৌধুরী
পর্ব ৩৫। ‘শাহজাদা দারাশুকো’ আরও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে ছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের
পর্ব ৩৪। একজন লেখক হিসেবে আমি কি তোমার মনোযোগের যোগ্য নই, অভিমান ভরা চিঠি লিখেছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
পর্ব ৩৩। আমাকে ভাবায়, তারাপদ রায়
পর্ব ৩২। নববর্ষের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ: লেখকদের মন্তব্যের খাতা!
পর্ব ৩১। পরিব্রাজক সন্ন্যাসী তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী ভাগ্যিস থিতু হয়েছিলেন সাহিত্যে!
পর্ব ৩০। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোনও বই আমাকে চাপিয়ে দেননি, লিখেছেন: বিবেচনা করে দেখো
পর্ব ২৯। কবিতাকে শক্তিদা বলতেন ‘জলজ দর্পণ’, তাঁর বেঁচে থাকার অবলম্বন
পর্ব ২৮। পিঁপড়ে কালিতে চুবিয়ে সাদা পাতায় ছাড়া হয়েছে, এমন পাণ্ডুলিপি ছিল বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের!
পর্ব ২৭। নিজস্ব ঈশ্বরভাবনা থাকলেও শঙ্কু মহারাজের লেখার মূল বিষয় ছিল মানুষের আলো-আঁধারি জীবন
পর্ব ২৬। বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও একুশে বইমেলায় কখনও স্টল পাইনি
পর্ব ২৫। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মুহূর্তের রক্ত-ঘাম-হাসি-কান্নার এক জীবন্ত দলিলচিত্র ছেপেছিলাম
পর্ব ২৪। রাখাল ছেলে যেমন বাঁশি বাজায়, আমিও তেমন নিজের খুশিতে লিখি, বলেছিলেন যাযাবর
পর্ব ২৩। রয়্যালটি-মুক্ত বইয়ের ওপর প্রকাশকদের ঝোঁক চোখে পড়ছে বইমেলাতেও
পর্ব ২২: শেষমেশ রেগে গিয়ে আমাকে চিঠিই লিখে ফেলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ!
পর্ব ২১: ৩০০০ কপি বিক্রির মতো জীবিত বা মৃত লেখক আর হয়তো নেই
পর্ব ২০: কম বয়সে আমাদের রোববারের আড্ডা ছিল ২৮ নম্বর প্রতাপাদিত্য রোড, আশুদার বাড়িতে
পর্ব ১৯: ‘লেখা বড় হচ্ছে’ অভিযোগ আসায় খুদে হাতের লেখায় পাণ্ডুলিপি দিতেন প্রবোধবন্ধু অধিকারী
পর্ব ১৮: দু’বছরের মধ্যে সংস্করণ না ফুরলে অন্য জায়গায় বই ছাপার চুক্তি ছিল শরদিন্দুর চিঠিতে
পর্ব ১৭: পূর্ণেন্দু পত্রীর বাদ পড়া প্রচ্ছদ ও দিনেশ দাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ দিনগুলি
পর্ব ১৬: সব প্রকাশনার যাবতীয় বইয়ের হদিশ পাওয়া যেত ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’তে
পর্ব ১৫: নিছকই একটা পত্রিকা নয়, ‘কলেজ স্ট্রীট’ আমাদের আবেগ
পর্ব ১৪: খুদে পাঠকদের জন্য মিনিবই তৈরির কথা প্রথম ভেবেছিলেন অভয়দা
পর্ব ১৩: কয়েকটি প্রেসের গল্প
পর্ব ১২: দীর্ঘায়ু বই ও আইয়ুব পরিবার
পর্ব ১১: প্রেমের নয়, অপ্রেমের গল্প সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন সুনীল জানা
পর্ব ১০: ছোট্ট অপুকে দেখেই রঙিন ছবিতে ভরা টানটান গল্পের বই করার ইচ্ছে জেগেছিল
পর্ব ৯: চানঘরে গান-এ সত্যজিৎ রায়ের চিঠি থাকায় ব্যাপারটা গড়িয়েছিল কোর্ট কেস পর্যন্ত
পর্ব ৮: প্রকাশক-লেখকের কেজো সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহর বিশ্বাস ছিল না
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম