রবীন্দ্রনাথের জন্ম-সার্ধশতবর্ষে দে’জ পাবলিশিং থেকে অপুর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আপনি তুমি রইলে দূরে/ সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ’– মূলত নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মীরা চট্টোপাধ্যায়কে লেখা রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠির সংকলন। সেইসঙ্গে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য চিঠিও ছিল। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ১৯২১ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর কর্মসচিব ছিলেন। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ১৯৫১ সালে তিনিই প্রথম উপাচার্য হন। কিন্তু তারপর থেকে নানা বিতর্কে জড়িয়ে বিরক্ত রথীন্দ্রনাথ নিজের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন বিশ্বভারতীর আচার্য জহরলাল নেহরুকে। এইসব বিতর্কের অন্যতম ছিল আশ্রমের অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরার সঙ্গে তাঁর ব্যতিক্রমী ঘনিষ্ঠতা।
৪০.
শান্তিনিকেতনের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের কথা তো বলতেই হবে। ১৯৮১ সালে দে’জ পাবলিশিং থেকে অমিতদার প্রথম বই প্রকাশিত হয়– ‘রবীন্দ্রনাথ : সাধনা ও সাহিত্য’। ‘লেখক’ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে-সঙ্গে এই বইয়ে ‘সম্পাদক’ রবীন্দ্রনাথও তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের লেখার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করাটা রবীন্দ্র গবেষকদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি বুঝেই অমিতদা এই কাজটি শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন– ‘সাধনা’, ‘ভারতী’, ‘বঙ্গদর্শন (নবপর্য্যায়)’, ‘ভাণ্ডার’, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’। পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘সাধনা’র সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগ ছিল সবচেয়ে নিকট। এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল মোট চার বছর। প্রথম তিন বছর সম্পাদক হিসেবে নাম থাকত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের– যদিও ‘সাধনা’ পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথকে প্রচুর লিখতে হত, অন্যের লেখা সম্পাদনাও করতে হত। পত্রিকার শেষ অর্থাৎ চতুর্থ বর্ষে সম্পাদক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নামই ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথ পত্রিকার জন্য এই বিপুল লেখার চাপের কথা যেমন বলেছেন, তেমনই ‘সাধনা’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইন্দিরা দেবীকে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ সালে কটক থেকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছেন– ‘…যখন মন একটু খারাপ থাকে তখনই সাধনাটা অত্যন্ত ভারের মতো বোধ হয়। মন ভালো থাকলে মনে হয়, সমস্ত ভার আমি একলা বহন করতে পারি। তখন মনে হয়, আমি দেশের কাজ করব এবং কৃতকার্য হব। তখন লোকের উৎসাহ এবং অবস্থার অনুকূলতা কিছুই আবশ্যক মনে হয় না, মনে হয় আমার নিজের কাজের পক্ষে আমি নিজেই যথেষ্ট। তখন এক-এক সময়ে আমি নিজেই খুব দূর ভবিষ্যতের যেন ছবি দেখতে পাই– আমি দেখতে পাই, আমি বৃদ্ধ পক্বকেশ হয়ে গেছি, একটি বৃহৎ বিশৃঙ্খল অরণ্যের প্রায় শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁচেছি, অরণ্যের মাঝখান দিয়ে বরাবর সুদীর্ঘ একটি পথ কেটে দিয়ে গেছি এবং অরণ্যের অন্য প্রান্তে আমার পরবর্তী পথিকেরা সেই পথের মুখে কেউ কেউ প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছে, গোধূলির আলোকে দুই-এক জনকে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। আমি নিশ্চয় জানি ‘আমার সাধনা কভু না নিষ্ফল হবে’। ক্রমে ক্রমে অল্পে অল্পে আমি দেশের মন হরণ করে আনব– নিদেন আমার দু-চারটি কথা তার অন্তরে গিয়ে সঞ্চিত হয়ে থাকবে। এই কথা যখন মনে আসে তখন আবার সাধনার প্রতি আকর্ষণ আমার বেড়ে ওঠে। তখন মনে হয় সাধনা আমার হাতে কুঠারের মতো, আমাদের দেশের বৃহৎ সামাজিক অরণ্য ছেদন করবার জন্যে এ’কে আমি ফেলে রেখে মর্চে পড়তে দেব না– এ’কে আমি বরাবর হাতে রেখে দেব। যদি আমি আরও আমার সহায়কারী পাই তো ভালোই, না পাই তো কাজেই আমাকে একলা খাটতে হবে।’ ‘সম্পাদক’ রবীন্দ্রনাথের পত্রিকা নিয়ে এমন আবেগ সাধারণভাবে খুব একটা আলোচিত হয় না। কিন্তু অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের বইটিতে এই দিকটাই আলোচিত হল। যদিও রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সম্পাদক-সত্তা নয়, ‘রবীন্দ্রনাথ: সাধনা ও সাহিত্য’ বইটির ভরকেন্দ্র ছিল কেবলমাত্র ‘সাধনা’ পত্রিকা। অমিতদার এই বইটি অবশ্য অনেক পরে অন্য একটি সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
এর পরের বছর আমি প্রকাশ করি অমিত্রসূদনের দশটি প্রবন্ধের সংকলন– ‘রঙ্গমঞ্চে বঙ্কিম’। এই লেখাগুলিতে বঙ্কিমকে ঘিরে সেকালের দেশ-কাল ও মানুষের কথা এসেছে। আলোচনায় এসেছেন নটী বিনোদিনী, স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী; আছেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, মধুসূদন দত্ত; সেই সঙ্গে বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ-জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ। ভূমিকায় অমিতদা লিখেছিলেন– ‘বঙ্কিমকে সাহিত্যের সেই চিরকালের সিংহাসন থেকে একেবারে পাবলিক থিয়েটার মঞ্চে এনে খুব কাছ থেকে তাঁকে আমরা দেখতে চেষ্টা করেছি। গত শতকে সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চে প্রধান পুরুষ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রই। একালে বসে সেদিনের সেই রঙ্গমঞ্চে সত্যিই যদি কিছু আলোকসম্পাত করতে পারি তবেই আমার এ-লেখাগুলির সার্থকতা।’
অমিতদার বঙ্কিমচর্চার সূচনা ১৯৬৪ সালে। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বঙ্কিম সাহিত্যের পাঠান্তর’ নামে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ। এর পর থেকে তাঁর নিরন্তর বঙ্কিমচর্চা চলেছে। ২০১১ সালের জুন মাসে দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর চব্বিশটি প্রবন্ধের সংকলন– ‘বঙ্কিম-সৃষ্টি-সমীক্ষা’।
আমার সংগ্রহে দেখছি ১৯৮৩-র আগে লেখা অমিতদার কোনো চিঠিপত্র নেই। সেবছর মে মাসে আমি তাঁর সম্পাদনায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম। বইটি প্রথমবার প্রকাশিত হয়েছিল তার বহুদিন আগে– ১৯৬৬ সালে। ১৯৮৩-র ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি শান্তিনিকেতনের ৩৮ নম্বর অ্যান্ড্রুজ পল্লীর বাড়ি থেকে ইনল্যান্ড লেটারে আমাকে একটি চিঠিতে লিখেছেন–
‘শ্রীসুধাংশুশেখর দে
প্রিয়বরেষু,
আশা করি কুশলে আছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ছাপার কাজ প্রায় দেড় মাসের ওপর প্রেসে আটকে আছে। আমি মাস খানেক আগে নিজে প্রেসে গিয়ে বংশীবাবুকে তাগাদা দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু দেখছি, আমার তাগাদায় কোনো ফল ফলছে না। এমন একটা চালু বই বাজারে চার বছর নেই। অথচ সকলেই জানে দে’জ থেকে চতুর্থ সংস্করণ ছাপা হচ্ছে। সুধাংশুবাবু, আপনি নিজে এ-ব্যাপারে বংশীবাবুকে বিশেষভাবে না বললে বই কবে বেরবে বলা কঠিন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহৎ ছাত্রসমাজের খুবই ক্ষতি হচ্ছে; আমাদেরও হচ্ছে। অথচ বইটি শেষ হতে আর মাত্র কয়েকটি ফর্মা বাকি।
আমি আশা করব, আপনি এ চিঠি পেয়ে আজই অনুগ্রহ করে বংশীবাবুকে নির্দেশ দেবেন বইইয়ের কাজ সমাপ্ত করে ফেলার জন্য। অন্তত যাতে ১লা বৈশাখ বইটি প্রকাশিত হয়– তা তো দেখতেই হবে।
প্রীতিবদ্ধ
অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য’
চিঠিতে উল্লিখিত বংশীবাবু হলেন নরেন্দ্র সেন স্কোয়ারে বাণী মুদ্রণ প্রেসের বংশীধর সিংহ। বংশীবাবুর প্রেসের কথা আগেও বলেছি, আমার অনেক বইয়ের কাজ ওখান থেকে হয়েছে। আমিতদার বইটি যদিও সেবছরের পয়লা বৈশাখে প্রকাশ করা যায়নি। কিন্তু তিনি যে সেবার আমাদের নববর্ষের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তা তাঁরই একটি চিঠি থেকে বুঝতে পারছি। ১৯৮৩-র মে মাসে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশের (প্রথম দে’জ সংস্করণ) পর ২০২২ পর্যন্ত বইটির আঠেরোটি সংস্করণ হয়েছে। ছাত্রছাত্রী, গবেষক মহলে এর চাহিদা এখনও আছে। অমিতদা ‘বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সমগ্র’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর বাবা বিজনবিহারী ভট্টাচার্যকে। বিজনবিহারী একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক ছিলেন। বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের লেখা বইপত্রও কম নয়– ‘প্রভাত রবি’, ‘গান্ধীজীর জীবনপ্রভাত’, ‘বাগর্থ’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত বই।
অমিতদার সম্পাদনায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেরও কয়েকটি বই আমি প্রকাশ করেছি– ‘পরামৃত শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, ‘পঞ্চকবির চৈতন্যজীবনী’ (সুজিতকুমার বিশ্বাসের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায়)। ‘পঞ্চকবির চৈতন্যজীবনী’র পাঁচজন কবি হলেন– বৃন্দাবন দাস, লোচন দাস, জয়ানন্দ, কৃষ্ণদাস কবিরাজ এবং গোবিন্দদাস। বইটির পরিচিতি দিতে গিয়ে ব্লার্বে লেখা হয়েছিল– ‘…পাঁচ চৈতন্যজীবনীকাব্যকারের রচনা থেকে নির্বাচন করে, মূল কাব্য থেকে সেরা অংশগুলি বাছাই করে তবেই এমন একখানি পূর্ণাঙ্গ চরিতামৃত সম্পাদনা করা সম্ভব হয়েছে। যে পরিকল্পনায় একদিন ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’ রচিত হয়েছিল, অনেকটা সেই পরিকল্পনাতেই সম্পাদিত হয়েছে ‘পঞ্চকবির শ্রীচৈতন্যজীবনী’…।’ আবার, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তাঁর সম্পাদনায় মালাধার বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ বইটিও দে’জ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
এর আগেই ২০০৬ সালে বইমেলার সময় প্রকাশিত হয়েছে মোট ১১টি ‘প্রস্তাবে’ তাঁর রবীন্দ্রভাবনার সংকলন– ‘রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই’। এই বইটির প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথের যে-চারটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলি ১৯৪০ সালে বিশিষ্ট আলোকচিত্রী শম্ভু সাহার তোলা। শম্ভু সাহার বিখ্যাত চিত্রগ্রন্থ হল বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘Faces & Places of Visva-Bharati’।
অমিতদা ১৯৮৫ সালে ছোটোদের জন্য আমাকে একটি চমৎকার বই তৈরি করে দিয়েছিলেন– ‘কিশোর বঙ্কিম রচনাবলী’। বঙ্কিমচন্দ্রের ১৪টি উপন্যাসের কাহিনি তিনি কিশোদের উপযোগী করে পুনর্লিখন করেছিলেন। ‘প্রকাশকের নিবেদন’ অংশে লেখা হয়েছিল– ‘চার্লস ল্যামের জগৎজোড়া জনপ্রিয় বই ‘টেল্স্ ফ্রম শেক্স্পীয়র’-এর আদর্শে পরিকল্পিত মহান্ স্রষ্টা সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র উপন্যাসের এই জনপ্রিয় কিশোর সংস্করণ। ক্লাসিক সাহিত্যের কাহিনী চিরকাল সব দেশের ছোট বড় সব বয়সের মানুষকেই সমানভাবে আকর্ষণ করে– চিরায়ত সাহিত্যের প্রধান বিশেষত্বই এই। তাই রামায়ণ মহাভারত কাব্য, শেক্স্পীয়রের নাটক বা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের কাহিনী শুধু বড়দের নয়, ছোটদের কাছেও পরম আকর্ষক পরম কৌতূহলোদ্দীপক। একটি খণ্ডের মধ্যে সাহিত্যসম্রাটের সমগ্র উপন্যাস চলিত ভাষায় ছোটদের সম্পূর্ণ উপযোগী করে অতি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেছেন বঙ্কিম-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড: অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। এই কিশোর সংস্করণ বঙ্কিম-রচনাবলী বাঙালীর ঘরে ঘরে ছোটদের হাতে পৌঁছলে আমাদের প্রয়াস সার্থক জ্ঞান করব।’ বইটিতে সুধীর মৈত্রর আঁকা বেশ কিছু রঙিন ছবিও ছিল। প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্য চক্রবর্তী। সেসময় আমি শ্রীগোপাল মল্লিক লেনে পঞ্চানন জানা-র জানা প্রিণ্টিং কনসার্ন থেকে বইটি ছেপেছিলাম। ‘কিশোর বঙ্কিম রচনাবলী’ প্রকাশের পর যথেষ্ট সাড়াও পেয়েছিলাম। পুরনো কাগজের মধ্যে অমিতদার নিজের হাতে লেখা বইটির একটি বিজ্ঞাপনের কপিও পেয়ে গেলাম, যেখানে উনি লিখেছেন– ‘এদেশে এমন চিত্রবহুল মনমাতানো রাজকীয় শোভন প্রকাশন কদাচিৎ ঘটে।’
গত শতাব্দীর নয়ের দশকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয় মেদিনীপুর জেলার এগরার বাসিন্দা রতন পয়রা। শিক্ষিত যুবক রতন আমাদের বাড়ির খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। রতন থাকত সুরেন্দ্রনাথ কলেজের হস্টেলে। অপু তখন স্কুলের ছাত্র। রতন ওকে লেখাপড়াতেও সাহায্য করত। তখনই আমাদের মাথায় আসে বাবার প্রতিষ্ঠা করা দে বুক স্টল নতুন করে চালু করলে কেমন হয়! দে বুক স্টোর তৈরি হওয়ার পর কালের নিয়মেই দে বুক স্টল বন্ধ হয়ে যায়, পরে দে’জ পাবলিশিং-এর নিজস্ব কাউন্টারও তৈরি হয়েছে– কিন্তু দে বুক স্টল, মানে দেওয়ালের গায়ে কয়েকটা তাক মাত্র সম্বল, বাবার গড়া বইপাড়ায় আমাদের প্রথম ঠিকানাটা– আমরা হাতছাড়া করিনি। আজও না। স্টল বন্ধ থাকলেও এখনও প্রতি মাসে নির্দিষ্ট ভাড়া দিয়ে ছোট্ট জায়গাটি আমরা ধরে রেখেছি। রতন পয়রার সঙ্গে যোগাযোগের পর মনে হল দে বুক স্টল ফের চালু করা যেতে পারে। ১৯৯৫-’৯৬ সাল থেকে বেশ কয়েকবছর রতন দায়িত্ব নিয়ে দে বুক স্টল চালিয়েছিল। সেসময়েই স্টলের মধ্যে থাকা দুটো পুরোনো বই অপুর নজরে পড়ে। লেখকের নাম তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়, আর বই দুটি হল– ‘পলাশির যুদ্ধ’ আর ‘পলাশির পর বক্সার’।
তপনমোহন পিতৃকুলে রামমোহন রায়ের বংশধর আর তাঁর মাতৃকুল হল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। তাঁর মা সরোজাসুন্দরী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে। সেই সূত্রে তপনমোহন রবীন্দ্রনাথের নাতি। তাঁর বাবা প্রখ্যাত অ্যাটর্নি মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় আবার থিওজফির প্রচারে একনিষ্ঠ ছিলেন। মাদাম ব্লাভাট্স্কির আমন্ত্রণে ইংল্যান্ডেও যান। কবি ইয়েটস এবং তাঁর লেখক-বন্ধুদের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ইয়েটস তাঁকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিলেন। মোহিনীমোহনের বাকপটুতা ছিল অসামান্য। তাঁর ছেলে তপনমোহন পেয়েছিলেন ঝরঝরে বাংলা লেখার গুণ। তপনমোহন ছিলেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্র– রবীন্দ্রনাথের ‘সাক্ষাৎ শিষ্য’। পরবর্তীকালে তিনি ব্যারিস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান এবং স্বাধীনতার পর দু’-বছরের জন্য ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জেনারেল অ্যান্ড অফিসিয়াল ট্রাস্টি অফ বেঙ্গল’ পদে কাজ করেন। কিন্তু সাহিত্যে মনোনিবেশ করতে একসময় স্বেচ্ছাবসর নেন। অপু যে দুটো পুরোনো বই দে বুক স্টল থেকে পেয়েছিল– সে নিজে প্রকাশনায় পুরোপুরি চলে আসার পর বই দুটো নতুন করে ছাপবে বলে ঠিক করে। তখন তপনমোহনের মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মোট তিনটি বই প্রকাশ করার কথা হয়। আগের দুটো বইয়ের সঙ্গে হাতে আসে ‘মানদণ্ড ছেড়ে রাজদণ্ড’। তবে এই বইটি তপনমোহন শেষ করে যেতে পারেননি। বইটির প্রথম ন’টি অধ্যায় তাঁর রচনা। শেষ অধ্যায়টি তিনি লিখে যেতে না-পারায় কাহিনিগত অসঙ্গতি রয়ে গিয়েছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত দশম অধ্যায়টি লিখে দিয়েছিলেন। তিনটির মধ্যে দু’টি বই সম্ভবত নাভানা-র ছিল। কেবল ‘পলাশির পর বক্সার’-এর প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিল কানাইলাল সরকারের ত্রিবেণী প্রকাশন থেকে। দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশের সময় বই তিনটি প্রকাশন-সম্পাদনার কাজ করেছিলেন আনন্দ পাবলিশার্সের শোভন বসু। শোভনদার কথা আগেও বলেছি– প্রচারবিমুখ, কাজে নিমগ্ন একজন মানুষ। ‘পলাশির যুদ্ধ’ বইটির ক্ষেত্রে দেখা যায় লেখকের জীবদ্দশায় তার তিনটে সংস্করণ হয়েছে। তৃতীয় সংস্করণের পর তপনমোহন পেনসিলে একটি বইতে বেশ কিছু সংশোধন করেন। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তাঁর মৃত্যুর বহু পরে প্রকাশিত চতুর্থ সংস্করণে সেইসব সংশোধন গৃহীত হয়নি। পোকায় কাটা, জীর্ণ হয়ে আসা, লেখকের সংশোধন সমেত বইটি অপু তপনমোহনের বাড়ি থেকে জোগাড় করে আনলে শোভনদা অনেক পরিশ্রম করে তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কাঙ্ক্ষিত পাঠ নির্মাণ করেন। ২০০৩ সালে বইমেলার সময় তিনটি বই– ‘পলাশির যুদ্ধ’, ‘পলাশির পর বক্সার’ এবং ‘মানদণ্ড ছেড়ে রাজদণ্ড’– দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়। এর প্রায় সতেরো বছর পরে পুলক চন্দের সম্পাদনায় আমরা তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের ‘রচনাসমগ্র’ প্রকাশ করেছি। পুলকদা এই সময়ের একজন বিশিষ্ট গ্রন্থ সম্পাদক, তাঁর কথা পরে বিশদে বলব।
শান্তিনিকেতনের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ক্ষিতীশ রায়ের জীবৎকালে আমরা তাঁর কোনো বই প্রকাশ করতে পারিনি। কিন্তু ২০০৮ সালে আহমেদাবাদের নবজীবন ট্রাস্ট এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ কালচারাল টেক্সট্স্ অ্যান্ড রেকর্ডস্-এর সহযোগিতায় দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয় শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উপক্রমণিকা’ সহ ক্ষিতীশ রায় অনূদিত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী-র ‘আত্মকথা অথবা সত্যের সন্ধানে’। ক্ষিতীশ রায় ১৯৩৪ সাল থেকে শান্তিনিকেতনের শিক্ষাভবনে শিক্ষকপদে নিযুক্ত ছিলেন। তার আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করেন। সেখানে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন কবি বিষ্ণু দে। শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পর তিনি ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’র সম্পাদনায় কৃষ্ণ কৃপালনির সহযোগী ছিলেন। পরে অবশ্য এককভাবেও এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। রবীন্দ্রভবনের প্রধান রূপকারদের মধ্যে তিনি একজন। পরে গান্ধী স্মারকনিধির কিউরেটর হিসেবেও কাজ করেছেন। সাত বছর ছিলেন সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চলীয় শাখার সম্পাদক। ‘আত্মকথা অথবা সত্যের সন্ধানে’ ছাড়াও তিনি তলস্তয়, টমাস মান-এর উপন্যাস এবং জওহরলাল নেহরুর ‘দ্য ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’র মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বইয়েরও অনুবাদক। ‘আত্মকথা অথবা সত্যের সন্ধানে’ প্রকাশের বেশ কয়েক বছর পরে, ২০২০ সালে, দে’জ থেকে প্রকাশিত হয় ক্ষিতীশ রায়ের লেখা ‘আমাদের বিশ্বকবি’। কিশোরদের উপযোগী এই রবীন্দ্রজীবনী তিনি রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে ভারত সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অনুরোধে রচনা করেছিলেন। পরে এটি ‘রবি পরিক্রমা’ নাম দিয়ে ভারত সরকারের প্রকাশন বিভাগ থেকেও বেরোয়। আমরা অবশ্য প্রথম প্রকাশকালের নামটিই রেখেছি।
শান্তিনিকেতনের লেখকদের প্রসঙ্গে এর আগে একবার আলপনা রায়ের কথা বলেছি। আলপনাদি শান্তিনিকেতনেই বড়ো হয়েছেন। একেবারে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে পিএইচডি পর্যন্ত– সবটাই সেখানে। সত্যেনদার (সত্যেন্দ্রনাথ রায়) আত্মজীবনীতেও আলপনাদির কথা আছে। তিনি সত্যেনদার ছাত্রী থেকে সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সহকর্মী হন, পরে সত্যেনদার ভাষায়– ‘আমার অন্যতম অভিভাবিকা’। আলপনাদির উদ্যোগে যখন ‘সপ্তক’ নামে সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল– প্রথম দিকে সত্যেনদা ছিলেন তার সভাপতি। ‘সপ্তক’-এর দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল– ‘ওই আসনতলে’। রবীন্দ্র-অভিপ্রায় অনুসারে রবীন্দ্রসংগীত-ধারাকে রক্ষা করাই ‘সপ্তক’-এর ব্রত। ‘ওই আসনতলে’ রবীন্দ্রসংগীতের ২৭জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের রচনার সংকলন। বইটি প্রথমে প্যাপিরাসের সহযোগিতায় ‘সপ্তক’ নিজেই প্রকাশ করে। পরে ২০১৯ সালে আমরা দে’জ পাবলিশিং থেকে বইটি প্রকাশ করি। সঞ্জয় রক্ষিতের প্রচ্ছদচিত্র আর শমীন্দ্র ভৌমিকের প্রচ্ছদ লিপি নিয়ে চমৎকার মলাটের বইটি আমার খুবই প্রিয়।
এর আগেই, ২০০৭ সালে আমি প্রকাশ করেছিলাম আলপনা রায়ের সংকলন ও সম্পাদনায় ‘রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী গান’। ‘শঙ্খদা-প্রতিমাদিকে’ (শঙ্খ ঘোষ ও প্রতিমা ঘোষ) উৎসর্গ করা বইটির জন্য ১৮৯০ সালে জোড়াসাঁকোয় অভিনীত ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবীর ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করেছিলেন দেবব্রত ঘোষ। বইয়ের পরিচিতিতে লেখা হয়েছিল– ‘রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘকালীন নাটকচর্চায় (১৮৮১-১৯৩৯) গানের প্রয়োগ অবিরল। গানের নাটক কিংবা নাটকে গানের ব্যবহার, সর্বত্রই গানে চলেছে নাট্যমুক্তির সন্ধান। এই লক্ষ্যেই সূচনাপর্বের গীতিনাট্য থেকে নাটকে গানের পথ ধ’রে অন্ত্যজীবনে পৌঁছেছেন নতুন এক গানের নাটক নৃত্যনাট্যে, যেখানে গানের সঙ্গে এল নাচ। গান হল নাটকের সংলাপ আর নাচ তার অভিনয়। রবীন্দ্রনাটকে গানের বিচিত্র প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নাট্যমুক্তির ক্রমবিকাশময় অভিপ্রায়ের অন্বেষণ করা হয়েছে এই বইতে।’
২০১৩ সালে আলপনাদির সম্পাদনায় দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয় শান্তিদেব ঘোষের ‘স্মৃতি ও সঞ্চয়’। এই বইয়ের প্রথমে আছে শান্তিদেবের সাক্ষাৎকার; তারপর শান্তিদেবকে লেখা রবীন্দ্রনাথের তিনটি চিঠি; তৃতীয় অংশে রাখা হয়েছে শান্তিদেবের সংগ্রহে থাকা তখনও পর্যন্ত অপ্রকাশিত পাঁচটি রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রনাথের সুরারোপিত একটি সংস্কৃত মন্ত্র এবং একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের (বিশ্ববিদ্যা তীর্থ প্রাঙ্গণ) অপ্রচলিত সুর। সাতটি গানের স্বরলিপিই এই অংশে সংযোজিত হয়। শেষ বয়সে শান্তিদেব এই গানগুলির কয়েকটি রেকর্ড ক’রে যান, সেগুলি একটি CD-তে এই বইয়ের সঙ্গে দেওয়া হয়। সবশেষে ছাপা হয় বেশ কিছু আলোকচিত্র।
এই বইয়ের প্রধান অবলম্বন আশ্রমিক-শিল্পী শান্তিদেব ঘোষের বেশ লম্বা এক সাক্ষাৎকার। ১৯৮৫ সালে সস্ত্রীক শান্তিদেব বেড়াতে গিয়েছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শমীক ঘোষের কাছে হিমাচল প্রদেশে। শমীক ঘোষ তখন লরেন্স স্কুল, সানাওয়ারে কর্মরত। সেখানেই শমীকবাবু এবং তাঁর স্ত্রী অনুত্তমা ঘোষ শান্তিদেবের নানা বিষয়ে মন্তব্য স্মৃতিধর ফিতেয় ধরে রাখেন। পরে সেই ১৫০ মিনিটের রেকর্ডিং থেকেই ‘স্মৃতি ও সঞ্চয়’ বইয়ের সাক্ষাৎকারটি নির্মিত হয়।
শান্তিদেব ঘোষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং আশ্রমিক কালীমোহন ঘোষের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁরা ছয়ভাই এক বোন। বোন সুজাতা আর ভাইয়েরা হলেন– শান্তিদেব, সাগরময়, সমীরময়, সলিল, সুবীরময়, এবং শুভময়। ভাইয়েরা প্রায় সকলেই বিখ্যাত বাঙালি। শান্তিদেবের নাম প্রথমে ছিল শান্তিময়, পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নামকরণ করেন শান্তিদেব। সাগরময় ‘দেশ’ পত্রিকার কিংবদন্তি তুল্য সম্পাদক। সলিল ঘোষ এবং শুভময় ঘোষও যথেষ্ট পরিচিত লেখক। শান্তিদেবের সাক্ষাৎকারটি যে দু’-জন নিয়েছিলেন তাঁরা হলেন শুভময় ঘোষের পুত্র এবং পুত্রবধূ।
অকাল প্রয়াত শুভময় ঘোষ লেখক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতিমান ছিলেন। তাঁর ‘শান্তিনিকেতনের চিঠি’, ‘মস্কোর চিঠি’ বইগুলির কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু তিনি যে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে বাংলায় রুশ সাহিত্য অনুবাদের কাজও করেছেন তা বোধহয় সবাই খেয়াল করেন না। প্রখ্যাত অনুবাদক অরুণ সোম ‘তাঁহাদের কথা’ নামক একটি নিবন্ধে লিখেছেন– ‘১৯৩১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় প্রকাশন সমিতির উদ্যোগে বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় সোভিয়েত সাহিত্যের এবং রুশ ভাষায় বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ– মূলত মানববিদ্যা সংক্রান্ত এবং সর্বোপরি ভাবাদর্শগত গ্রন্থাদি প্রচারের উদ্দেশ্যে মস্কোয় ‘বিদেশী শ্রমজীবীদের প্রকাশন সমিতি’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে সংস্থাটি নাম বদল করে ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ এবং ১৯৬৩ সাল থেকে ‘প্রগতি প্রকাশন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে– তখনও অনুবাদ সাহিত্যের এই প্রকাশালয়টি ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ নামে পরিচিত– সেই সময় সেখানে স্থায়ী বাংলা বিভাগ গড়ে উঠেছিল। সেই পর্বে অনুবাদক হিসেবে আমাদের দেশ থেকে সেখানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন : ননী ভৌমিক, নীরেন্দ্রনাথ রায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (তাঁর স্ত্রী রেখা চট্টোপাধ্যায়ও কিছু অনুবাদ করেছিলেন), ফল্গু কর, সমর সেন ও শুভময় ঘোষ (শুভময় ঘোষের স্ত্রী সুপ্রিয়া ঘোষও কিছু অনুবাদ করেছিলেন)। সম্ভবত সেটা ১৯৫৭ সাল। এক কালের বিখ্যাত চলচ্চিত্র-অভিনেতা রাধামোহন ভট্টাচার্যও অল্প সময়ের জন্য সেখানে অনুবাদকের কাজ করেন। এরই কাছাকাছি কোন এক সময়ে কলকাতা থেকে বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ও যোগ দেন। কলকাতায় তিনি ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। ননী ভৌমিক ও বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় ছাড়া এই পর্বের অনুবাদকদের কারোই মস্কোয় অনুবাদকের কর্মজীবন তিন-চার বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি। দীর্ঘ দুই দশকব্যাপী অনুবাদকের কর্মজীবনের অন্তে অবসর নিয়ে আশির দশকে বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় দেশে ফিরে আসেন। একমাত্র ননী ভৌমিকই পাকাপাকি ভাবে মস্কোয় থেকে যান।’ শুভময় ঘোষের অনুবাদ করা বইগুলির মধ্যে আছে– ইভান ইয়েফ্রেমভের ‘ফেনার রাজ্য’ এবং ‘গল্প সংকলন’, আলেক্সান্দ্র বেকের ‘ভলকলামস্কয়ে সড়ক’, ভিতালি বিআংকির ‘হঠাৎ দেখা’, ইয়া. পেরেলম্যানের ‘জ্যোতির্বিদ্যার খোশখবর’ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি স্ত্রী সুপ্রিয়া ঘোষের সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেছিলেন মাৎভেই তেভেলভের ‘স্নেগোভেৎসের হোটেল’ এবং সমর সেনের সঙ্গে ‘রুশ চরিত্র’।
শান্তিদেবের বইটির অনেক আগে আমি ২০০৭ সালে প্রকাশ করেছিলাম পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘কবি ও কর্মী/ রবীন্দ্রনাথ ও কালীমোহন ঘোষ’। কালীমোহনের বন্ধু ক্ষিতিমোহন সেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকার আষাঢ় ১৩৪৪ সংখ্যায় তাঁর ‘সেবানিবেদিত জীবন’ রচনায় লিখেছেন কালীমোহনকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতার কথা–
‘১৯০৬ সাল। গ্রীষ্মকাল আরম্ভ হইয়াছে। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ হইতে আমার পিতৃভূমি বিক্রমপুর সোনারাং গ্রামে আসিয়া শুনিলাম এক দল স্বদেশী প্রচারক গ্রামে আসিয়াছেন। বৈকালে গ্রামে সভামধ্যে তাঁহাদের দেখিলাম। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বক্তা, আর কেহ কেহ গান করেন। সকলের মধ্যে দেখিলাম কালীমোহন ঘোষই যেন প্রাণস্বরূপ। শরীরের কিছুই নাই, অথচ উৎসাহে পরিপূর্ণ চিত্ত, তাহারই সাক্ষ্য দিবার উপযুক্ত দুইটি উজ্জ্বল চক্ষু। গ্রামের পুরন্ধ্রীরা এই প্রিয়দর্শন যুবকটিকে স্নেহে ও বাৎসল্যে একেবারে ঘরের ছেলে করিয়া লইয়াছেন। কালীমোহনের সঙ্গে আলাপ হইল। বড় ভাল লাগিল। দেখিলাম এই উৎসাহ-মাত্র-সম্বল যুবকটির শরীর শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন। একটু সেবা-যত্ন ও বিশ্রামের প্রয়োজন। গ্রামের মায়েরা সেবা ও যত্ন দিতে পারেন কিন্তু অবসর ও বিশ্রাম লইবার মত ধৈর্য্য কালীমোহনের নাই।…’
কালীমোহন ঘোষ রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশীসমাজ’ গঠনের ডাকে আকৃষ্ট হয়ে ধীরে-ধীরে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। মাঝে দু-বছর ইংল্যান্ডে যান উচ্চতর পড়াশোনার জন্য। কিন্তু অর্থাভাবে পড়া অসমাপ্ত রেখেই তাঁকে ফিরতে হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতনের শিশুশিক্ষা বিভাগ এবং বয়স্কদের সাক্ষরতার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তার অনেক আগে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে থেকে তাঁর কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। ক্রমশ তিনি শ্রীনিকেতনের কাজেও লেনার্ড এলম্হার্স্টের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেন। পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘কবি ও কর্মী/ রবীন্দ্রনাথ ও কালীমোহন ঘোষ’ বইতে দেখছি কালীমোহনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের মোট বিয়াল্লিশটি চিঠি ছাপা হয়েছে। এগুলি ১৩৯৯ বঙ্গাব্দের শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কালীমোহনের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ কালিম্পঙ থেকে শান্তিদেবকে যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে কালীমোহনকে তিনি কী চোখে দেখতেন তা স্পষ্ট পড়তে পারা যায়–
‘কল্যাণীয়েষু,
তোমার পিতার মৃত্যুসংবাদে গুরুতর আঘাত পেয়েছি। শান্তিনিকেতনে আসবার পূর্ব থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার নিকট সম্বন্ধ ঘটেছিল। কর্মের সহযোগিতায় ও ভাবের ঐক্যে তাঁর সঙ্গে আমার আত্মীয়তা গভীরভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। অকৃত্রিম নিষ্ঠার সঙ্গে আশ্রমের কাছে তিনি আপনার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর আন্তরিক জনহিতৈষা শ্রীনিকেতনের নানা শুভকর কার্যে নিজেকে সার্থক করেছে।
তাঁর মূর্তি আমাদের আশ্রমে এবং আমার মনের মধ্যে চিরদিনের মত প্রতিষ্ঠিত হয়ে রইল।
লোকহিতব্রতে তাঁর যে জীবন ত্যাগের দ্বারা পুণ্যোজ্জ্বল ছিল মৃত্যু তার সত্যকে খর্ব করতে পারে না এই সান্ত্বনা তোমাদের শান্তি দান করুক।
ইতি ১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৮
শুভৈষী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’
কালীমোহন ঘোষের চতুর্থ সন্তান সলিল ঘোষের বই– ‘বোম্বাই বোম্বাই’ আমি প্রকাশ করেছিলাম ১৯৯৪ সালে বইমেলার সময়। সলিলদা দীর্ঘকাল আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীতে কাজ করেছেন। তিনি থাকতেন মুম্বইয়ের দাদর এলাকায়। ‘বোম্বাই বোম্বাই’ বইয়ের সূচনায় তার সম্পর্কে লেখা হয়েছিল–
‘বোম্বাই শহরের সলিল ঘোষকে এক প্রখ্যাত সাহিত্যিক একবার বঙ্গীয় সমাজের প্রবাদপুরুষ বলেছিলেন। প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন সলিল ঘোষ। তিনি নিজেকে বড়জোর কলকাতা-বোম্বায়ের হাইফেন মনে করেন। সোজা বাংলায় তাঁকে বলা যেতে পারে মহারাষ্ট্র ও বাংলার যোগাযোগ সেতু। বাংলার যাকিছু শ্রেষ্ঠ তা মহারাষ্ট্রের সুরসিক মানুষদের কাছে এবং মহারাষ্ট্রের মহত্বকে এই বাংলায় প্রসারিত করার জন্যে গত অর্ধশতাব্দীতে আর কোনো বাঙালি বোধহয় এতো তৎপর হননি।
সুদূর প্রবাসে যে-বাঙালিই বিপন্ন বোধ করেন তাঁর ঠিকানা সলিল ঘোষ। আবার স্থানীয় মহারাষ্ট্রীয় ও গুজরাতি সমাজে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সলিল ঘোষের প্রবল প্রতাপ। আসলে বসুধৈবকে কুটুম্বকম মনে করার প্রবণতা রয়েছে ওঁর রক্তে।…’
প্রসঙ্গত বলে রাখি, সংগীত ও সাহিত্যজগতে তাঁর দুই দাদার বিপুল খ্যাতি থাকলেও সলিল ঘোষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভিতে বেতার অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। বাহাত্তর বছর বয়স পেরিয়ে সলিলদা অনুরাগী-বন্ধুদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কলম ধরেছিলেন, বিষয়– তাঁর দেখা ‘বোম্বাই’। বইটির জন্য জলরঙে একটি চমৎকার প্রচ্ছদ তৈরি করে দেন আরেক মুম্বই প্রবাসী প্রখ্যাত বাঙালি শিল্পী সমীর মণ্ডল। এই বইটির সূত্রে সলিলদার সঙ্গে আমার বেশ কয়েকটি চিঠি চলাচালি হয়। একটি চিঠিতে দেখছি তিনি এই বই প্রকাশের পর মুম্বইয়ে তার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে সে সম্পর্কে আমাকে লিখেছেন–
‘প্রিয়বরেষু সুধাংশুবাবু,
এই সঙ্গে বম্বের প্রধান দুটি সংবাদপত্রে আপনার প্রকাশিত ‘বোম্বাই বোম্বাই’ সম্বন্ধে প্রচণ্ড প্রচারের কাটিং পাঠালাম।
১। মহারাষ্ট্র টাইমস– Top Class Marathi Daily with Top Class readership. মারাঠীতে অসাধারণ Prominency দিয়ে, অনুবাদ ছেপেছে, যা খুবই প্রশংসিত হয়েছে। পু. ল. দেশপাণ্ডে ও শঙ্কর [য.] এর নামও উল্লিখিত হয়েছে।
২। The Afternoon– Most popular Evening Paper এ শ্রী প্রাণেশ্বর নার্ডকারর্ণী [য.]– মারাঠী ও ইংরাজিতে লেখেন– Critic-Author– খুব সম্মানিত লেখক। উনি বইটিকে Masterpiece বলেছেন।…’
প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, এই বইটি তিনি পু. ল. দেশপাণ্ডে এবং সাহিত্যিক শংকরকে উৎসর্গ করেছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ছে মণিশঙ্করদার মাধ্যমেই সলিলদার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আর পুরুষোত্তম লক্ষণ দেশপাণ্ডে (পু. ল. দেশপাণ্ডে) শুধুমাত্র একজন মারাঠি লেখকই ছিলেন না, ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক মানুষ।
অপু ক্রমশ প্রকাশনায় জড়িয়ে পড়ায় পরের দিকে শান্তিনিকেতনের লেখকদের সঙ্গে ওর যোগাযোগই বেশি। যেমন, ২০১৭ সালের পঁচিশে বৈশাখ অনাথনাথ দাস ও অমল পালের সম্পাদনা ও উপস্থাপনায় একবছরের আয়ু-বিশিষ্ট ঠাকুরবাড়ি-কেন্দ্রিক পত্রিকা ‘বালক’-এর সংকলন দে’জ থেকে তার চেষ্টাতেই প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী এবং কার্যাধ্যক্ষ চব্বিশ বছর বয়সি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১২৯২ (১৮৮৫) বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে চৈত্র সংখ্যা পর্যন্ত মোট এগারোটি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়– বারোমাসে এগারো, কেননা আশ্বিন-কার্তিক যুগ্ম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের জন্ম-সার্ধশতবর্ষে দে’জ পাবলিশিং থেকে অপুর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আপনি তুমি রইলে দূরে/ সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ’– মূলত নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মীরা চট্টোপাধ্যায়কে লেখা রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠির সংকলন। সেইসঙ্গে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য চিঠিও ছিল। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ১৯২১ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর কর্মসচিব ছিলেন। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ১৯৫১ সালে তিনিই প্রথম উপাচার্য হন। কিন্তু তারপর থেকে নানা বিতর্কে জড়িয়ে বিরক্ত রথীন্দ্রনাথ নিজের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন বিশ্বভারতীর আচার্য জহরলাল নেহরুকে। এইসব বিতর্কের অন্যতম ছিল আশ্রমের অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরার সঙ্গে তাঁর ব্যতিক্রমী ঘনিষ্ঠতা। পদত্যাগপত্র গৃহীত হলে তিনি সম্ভবত ২২ অগাস্ট ১৯৫৩-য় উপাচার্যের দায়িত্ব বিশ্বভারতীর কর্মসচিবকে বুঝিয়ে দেন এবং তার কিছুদিন পর বরাবরের জন্য শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে আমৃত্যু স্বেচ্ছা-নির্বাসনে চলে যান দেরাদুনে। ‘নিরহং শিল্পী’ বইয়ের ‘পঞ্চবটী’ লেখাটিতে শঙ্খদা রথীন্দ্রনাথের অসমবয়সি বন্ধু, বিশিষ্ট লেখক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত-র প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বলেছেন–
‘…রথীন্দ্রনাথের আকস্মিক আশ্রমত্যাগ নিয়ে বহুদিন ধরেই একটা জিজ্ঞাসা ছিল মনে। তাই তাঁকে জিজ্ঞেস করে বসি:
‘কেন চলে গেলেন, এমন হঠাৎ !’
‘চলে যাননি, যেতে হলো।’ একটু থেমে বললেন : ‘সেই দিনটা কখনো ভুলব না। একদিন ভোর-ভোর সময়ে– পুরোপুরি আলো ফোটেনি তখনও– ঘুম ভেঙে হঠাৎ মনে হলো উত্তরায়ণের দিক থেকে কোনো একটা হল্লার আওয়াজ আসছে। কী হলো ওখানে? উদ্বেগ নিয়ে তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছে দেখি, উদয়ন-বাড়িটা ঘিরে বেশ বড়োসড়ো একটা জমায়েত, অশালীন চিৎকার করছে সবাই। খানিক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রথীবাবু। জনতা থেকে চিৎকার ওঠল : “ওই মহিলাকে এখনই বার করে দিতে হবে। এসব চলবে না এখানে।” স্তম্ভিত তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত, তাকিয়ে দেখলেন ভিড়টা, আর তারপর ঢুকে গেলেন ঘরে। একটু পরেই ভিতর থেকে যেন কিছু ভাঙচুরের শব্দ এসে পৌঁছতে লাগল। আরো একটু পরে বেরিয়ে এলেন রথীন্দ্রনাথ, হাতে শুধু ছোটো একটা সুটকেস, পাশে মীরা চট্টোপাধ্যায়। সবার দিকে তাকিয়ে বললেন : “আপনারা সরে দাঁড়ান। আমি এই মুহূর্তে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”– চলেও গেলেন, একটা রিক্সাতে উঠে, স্টেশনের দিকে। ভিড়টা মিলিয়ে যাবার পরে আমরা কয়েকজন ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখি চারদিকে পড়ে আছে অনেক শিল্পকলার ভগ্নাবশেষ। ওঁর নিজের হাতের বেশ কিছু শিল্পসামগ্রী চুরমার করে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন।’
‘কেউ আটকাবার চেষ্টা করল না ?’
‘না, কেউ না। এই মানুষটির ঠিক এমন বিদায় প্রাপ্য ছিল না।’ ’
‘আপনি তুমি রইলে দূরে/ সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ’ প্রকাশের পর বইটির প্রচ্ছদ নিয়েও কোনও-কোনও মহলে একটা আপত্তির সুর শুনেছিলাম। তাঁদের বক্তব্য ছিল সিগারেট ঠোঁটে রথীন্দ্রনাথের ছবিটা না কি রবীন্দ্রভাবাদর্শের সঙ্গে মেলে না। আমি জানি শুরুতে বইটার এই প্রচ্ছদ ছিল না। কিন্তু এই ছবিটা পাওয়ার পর অপু স্থির করে এ-ছবি দিয়েই বইয়ের মলাট হবে। বিভিন্ন মহলের আপত্তির কথা অপুকে বলায় সে আমাকে বলেছিল– রথীন্দ্রনাথ নিজে যদি সচেতনভাবে এই ছবি তুলতে পারেন, তাহলে আমাদের আপত্তির কী কারণ থাকতে পারে!
লিখন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
…………………… ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর অন্যান্য পর্ব …………………
পর্ব ৩৯। শান্তিনিকেতন থেকে কলেজ স্ট্রিট, প্রুফ আদান-প্রদানে সহায়ক ছিলেন বই ব্যবসায়ীরাই
পর্ব ৩৮। পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে সোমেনদা বলেছিলেন, রামকিঙ্করকে নিয়ে এ জাতীয় বই আগে লেখা হয়নি
পর্ব ৩৭। ‘কীর্তির্যস্য’র নাম বদলাতে চেয়েছিলেন ভবতোষ দত্ত
পর্ব ৩৬। কবি-দার্শনিকের বাইরে আরেক রবীন্দ্রনাথকে খুঁড়ে বের করেছিলেন অমিতাভ চৌধুরী
পর্ব ৩৫। ‘শাহজাদা দারাশুকো’ আরও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে ছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের
পর্ব ৩৪। একজন লেখক হিসেবে আমি কি তোমার মনোযোগের যোগ্য নই, অভিমান ভরা চিঠি লিখেছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
পর্ব ৩৩। আমাকে ভাবায়, তারাপদ রায়
পর্ব ৩২। নববর্ষের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ: লেখকদের মন্তব্যের খাতা!
পর্ব ৩১। পরিব্রাজক সন্ন্যাসী তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী ভাগ্যিস থিতু হয়েছিলেন সাহিত্যে!
পর্ব ৩০। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোনও বই আমাকে চাপিয়ে দেননি, লিখেছেন: বিবেচনা করে দেখো
পর্ব ২৯। কবিতাকে শক্তিদা বলতেন ‘জলজ দর্পণ’, তাঁর বেঁচে থাকার অবলম্বন
পর্ব ২৮। পিঁপড়ে কালিতে চুবিয়ে সাদা পাতায় ছাড়া হয়েছে, এমন পাণ্ডুলিপি ছিল বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের!
পর্ব ২৭। নিজস্ব ঈশ্বরভাবনা থাকলেও শঙ্কু মহারাজের লেখার মূল বিষয় ছিল মানুষের আলো-আঁধারি জীবন
পর্ব ২৬। বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও একুশে বইমেলায় কখনও স্টল পাইনি
পর্ব ২৫। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মুহূর্তের রক্ত-ঘাম-হাসি-কান্নার এক জীবন্ত দলিলচিত্র ছেপেছিলাম
পর্ব ২৪। রাখাল ছেলে যেমন বাঁশি বাজায়, আমিও তেমন নিজের খুশিতে লিখি, বলেছিলেন যাযাবর
পর্ব ২৩। রয়্যালটি-মুক্ত বইয়ের ওপর প্রকাশকদের ঝোঁক চোখে পড়ছে বইমেলাতেও
পর্ব ২২: শেষমেশ রেগে গিয়ে আমাকে চিঠিই লিখে ফেলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ!
পর্ব ২১: ৩০০০ কপি বিক্রির মতো জীবিত বা মৃত লেখক আর হয়তো নেই
পর্ব ২০: কম বয়সে আমাদের রোববারের আড্ডা ছিল ২৮ নম্বর প্রতাপাদিত্য রোড, আশুদার বাড়িতে
পর্ব ১৯: ‘লেখা বড় হচ্ছে’ অভিযোগ আসায় খুদে হাতের লেখায় পাণ্ডুলিপি দিতেন প্রবোধবন্ধু অধিকারী
পর্ব ১৮: দু’বছরের মধ্যে সংস্করণ না ফুরলে অন্য জায়গায় বই ছাপার চুক্তি ছিল শরদিন্দুর চিঠিতে
পর্ব ১৭: পূর্ণেন্দু পত্রীর বাদ পড়া প্রচ্ছদ ও দিনেশ দাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ দিনগুলি
পর্ব ১৬: সব প্রকাশনার যাবতীয় বইয়ের হদিশ পাওয়া যেত ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’তে
পর্ব ১৫: নিছকই একটা পত্রিকা নয়, ‘কলেজ স্ট্রীট’ আমাদের আবেগ
পর্ব ১৪: খুদে পাঠকদের জন্য মিনিবই তৈরির কথা প্রথম ভেবেছিলেন অভয়দা
পর্ব ১৩: কয়েকটি প্রেসের গল্প
পর্ব ১২: দীর্ঘায়ু বই ও আইয়ুব পরিবার
পর্ব ১১: প্রেমের নয়, অপ্রেমের গল্প সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন সুনীল জানা
পর্ব ১০: ছোট্ট অপুকে দেখেই রঙিন ছবিতে ভরা টানটান গল্পের বই করার ইচ্ছে জেগেছিল
পর্ব ৯: চানঘরে গান-এ সত্যজিৎ রায়ের চিঠি থাকায় ব্যাপারটা গড়িয়েছিল কোর্ট কেস পর্যন্ত
পর্ব ৮: প্রকাশক-লেখকের কেজো সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহর বিশ্বাস ছিল না
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম
জীবনে প্রথম প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সাহিত্যে সুকুমার রায়ের ইলাস্ট্রেশন নিয়ে। বিশেষ করে জোর দিয়েছিলাম হাইব্রিড জন্তু-জানোয়ার বানানোর দিকটায়। সেই লেখায় রায়সাহেব আমার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির মার্জিনে কিছু কিছু সংশোধনী নির্দেশ দিয়েছিলেন, শিক্ষকের মতো হাতের লেখায়। বারবার ছুঁয়ে দেখেছি মার্জিনে সে হাতের লেখা।