বিয়ের যেমন বাজার গরম করতে হয় তেমন কাগজের বাজারও গরম না করলেই নয়! সুতরাং বিয়ের গরম হাট-বাজারের মতো খবরের কাগজের হাট-বাজারও গরমেই উন্নত কিম্বা সমুন্নত। রবীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ‘ইংরাজি কাগজের দ্রুতলিখিত গরম গরম ঝাঁঝালো প্রবন্ধ’– তিনি জানেন এই সব তাৎক্ষণিক লেখা মানুষের বিচার বোধ করে দেয় অন্ধ। ‘ফলাফলবিচারী ধৈর্যশীল গবর্মেন্টের’ ব্যবহার ‘গরম গরম ঝাঁঝালো’ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাই তো সেকালের মতো একালেও হয়। তবে এরই মাঝে থাকেন কৌশলী কিছু নেতা– তাঁদের অন্যরকম সব কেতা।
৪৪.
যদিও আষাঢ় মাস তবু গরম এখন বারোমাস। সুতরাং সাধ জাগে, ‘গরম’ শব্দটি কেমন করে নানাভাবে ব্যবহার করেছিলেন রবি, তা দেখা যাক আগে! নামের গোড়াতেই তাঁর ‘সূর্য’ সুতরাং নানারকম গরম তাঁর লেখায় বাজাবেই রণতুর্য। খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই চক্ষু ছানাবড়া। ‘খাপছাড়া’-য় ‘গরম হল’ এই ব্যবহার চমৎকার, স্মরণ করা যাক সেই ছড়া।
“আদর ক’রে মেয়ের নাম
রেখেছে ক্যালিফর্নিয়া ,
গরম হল বিয়ের হাট
ঐ মেয়েরই দর নিয়া।
মহেশদাদা খুঁজিয়া গ্রামে গ্রামে
পেয়েছে ছেলে ম্যাসাচুসেট্স্ নামে,
শাশুড়ি বুড়ি ভীষণ খুশি
নামজাদা সে বর নিয়া —
ভাটের দল চেঁচিয়ে মরে
নামের গুণ বর্ণিয়া।”
রবীন্দ্রনাথ তাহলে শুধু রসিক নন, রীতিমতো ফাজিল ও দুষ্টু। ক্যালিফর্নিয়া নামের মেয়েটির সঙ্গে ম্যসাচুসেট্স্ নামক ছেলের বিয়ে হলেই যে রাজযোটক হবে সুষ্ঠু! সে আর বলতে! বিয়ের দোকানিরা বলে ‘আজ বাজার গরম’ শোনা যায় পথ চলতে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাই ‘গরম হল বিয়ের হাট’। ‘দেনাপাওনা’, গল্পের লেখক হিসেবে তিনি জানেন বিয়ে অতি বিষমবস্তু, বিয়ে তো নয় যেন দখল করা হচ্ছে রাজ্যপাট। সেখানে হাটের বেচা-কেনা নানাভাবে উঁকি দেয়। কে যে কাকে কখন কিনে নেয়! ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসেও তো বিয়ের হাট-বাজারেরই দাপট। পড়তি জমিদার, সে বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করছে উঠতি ব্যবসাদার। এই বিয়েই ‘টাকার গরম’ দেখানোর উপায় তার। কুমুদিনীকে বিয়ে করতে গিয়ে রাজ খেতাব পাওয়া মধুসূদন ঘোষাল, কুমুর দাদার জমিদারিতে টাকার গরমে দেখায় বিস্তর হাল-চাল।
“ঘোষালদিঘির ধারে জঙ্গল সাফ হয়ে গেল– চেনা যায় না।… ঘাটের কাছে তকতকে নতুন বিলিতি পাল-খেলাবার দুটি নৌকো, তাদের একটির গায়ে লেখা ‘মধুমতী’, আর-একটির গায়ে ‘মধুকরী’। যে তাঁবুতে রাজাবাহাদুর স্বয়ং থাকবেন তার সামনে ফ্রেমে হলদে বনাতের উপর লাল রেশমে বোনা ‘মধুচক্র’।… মাঝে একটি ছোটো বাঁধানো জলাশয়, তারই মধ্যে লোহার ঢালাই-করা নগ্ন স্ত্রীমূর্তি, মুখে শাঁখ তুলে ধরেছে, তার থেকে ফোয়ারার জল বেরোবে। এই জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মধুকুঞ্জ’।… নানা রঙের কাপড়ে কানাতে চাঁদোয়ায় নিশানে রঙিন ফুলে চীনালণ্ঠনে হঠাৎ-তৈরি এই মায়াপুরী দেখবার জন্যে দূর থেকে দলে দলে লোক আসতে লাগল।”
বিয়ের সঙ্গে এই যে গরম বাজারের যোগ, তাই রবীন্দ্রনাথের মতে নরনারীর মধ্যে তৈরি করে গভীরতর অযোগ।
আবার তাঁর অন্য লেখায় ফেরা, সেখানে গরমের আর কী কী চেহারা!
বিয়ের যেমন বাজার গরম করতে হয় তেমন কাগজের বাজারও গরম না করলেই নয়! সুতরাং বিয়ের গরম হাট-বাজারের মতো খবরের কাগজের হাট-বাজারও গরমেই উন্নত কিম্বা সমুন্নত। রবীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ‘ইংরাজি কাগজের দ্রুতলিখিত গরম গরম ঝাঁঝালো প্রবন্ধ’– তিনি জানেন এই সব তাৎক্ষণিক লেখা মানুষের বিচার বোধ করে দেয় অন্ধ। ‘ফলাফলবিচারী ধৈর্যশীল গবর্মেন্টের’ ব্যবহার ‘গরম গরম ঝাঁঝালো’ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাই তো সেকালের মতো একালেও হয়। তবে এরই মাঝে থাকেন কৌশলী কিছু নেতা– তাঁদের অন্যরকম সব কেতা। তাঁরা কী করেন? “দোষ যাহারই হউক বা রাগ যাহার ’পরেই থাক্ সে কথা লইয়া গরম না হইয়া হাতের কাজটা কী করিলে সিদ্ধ হয় এই ব্যবস্থা করিবার জন্যই তাহারা তৎপর হয়।” (যজ্ঞভঙ্গ) এঁরাই শেষ অবধি রাজনৈতিক দলের হালটি ধরেন।
রবীন্দ্রনাথ সাধারণভাবে কি তবে ‘গরম’ শব্দটিকে বিশেষণ পদ হিসেবে ব্যবহার করেননি? করেছেন। তা আমাদের চক্ষু এড়ায়নি।
‘তিনি কখনো নেকড়িয়া বাঘদিগকে গরম গরম মনুষ্য মাংস খাইতে দেন নাই’ (‘স্যাক্সন জাতি ও অ্যাংলো স্যাক্সন সাহিত্য’)
আপিসের অন্নের ন্যায় প্রত্যুষেই তাঁহাদিগকে খরতাপে চড়ানো হইয়াছে, এবং ক্রমাগত গরম মসলা পড়িতেছে– চেষ্টা হইতেছে যাহাতে দশ, বড় জোর সাড়ে দশের আগেই রীতিমত “কনে” পাকাইয়া তাঁহাদিগকে ভদ্রলোকের পাতে দেওয়া যাইতে পারে। (‘সমস্যা’)
বিশেষণেও রবীন্দ্রনাথ সবিশেষ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ‘গরম’ এই বিশেষণে বুঝিয়ে দেওয়া হল মেয়েদের কীভাবে সাংসারিক খরতাপে বাল্যেই বিবাহযোগ্য করে তুলে করা হবে নিকেশ! জয়, বাল্যবিবাহের জয়! একালেও এভাবেই মেয়েদের বলি দেওয়া হয়।
তবে? গরম কি তাঁর লেখায় সর্বদাই তির্যক গভীর অর্থে ব্যবহৃত হবে?
আছে, সহজ গরমকে বাদ দিয়ে লেখার গরুকে তিনি প্রথমেই উঠিয়ে দেননি গাছে।
‘শুক্নো খাবারটি গরম’ (‘ইংরেজি-সহজশিক্ষা’)
‘ছেলের হাতটি গরম’ (‘ইংরেজি-সহজশিক্ষা’)
শ্রুতি শিক্ষার বই থেকে আবার খাপছাড়ায় যাক ফেরা। সেখানে গরম খাবারের অন্যরকম সামাজিক চেহারা।
‘আপিস থেকে ঘরে এসে
মিলত গরম আহার্য,
আজকে থেকে রইবে না আর
তাহার জো।
বিধবা সেই পিসি ম’রে
গিয়েছে ঘর খালি করে,
বদ্দি স্বয়ং করেছে তার
সাহায্য।’ (খাপছাড়া)
এই ছড়াটি পড়ে, নারীবাদীদের রাগ উঠবে চড়ে। বিধবা পিসি মারা গেছেন দুঃখ নেই! আপিস থেকে ফিরে ঠান্ডা খেতে হবে দুঃখ কেবল সেই! নিষ্কর্মার ঢেঁকি, পুরুষগুলোই মেকি।
…ছাতিমতলা-র অন্যান্য পর্ব…
ছাতিমতলা পর্ব ৪৩: খেটে খাওয়া মানুষের সহজ পাঠ, রাজনৈতিক দল যদিও সেদিন বোঝেনি
ছাতিমতলা পর্ব ৪২: ‘রবি ঠাকুর’ ডাকটি রবীন্দ্রনাথ নিজেই তির্যকভাবেই ব্যবহার করতেন
ছাতিমতলা পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ফেসবুকে থাকলে যে ভাষায় ট্রোলড হতেন
ছাতিমতলা পর্ব ৪০: রবীন্দ্র-দেবেন্দ্র সম্পর্ক বাংলা ছবির উত্তমকুমার-কমল মিত্র সম্পর্ক নয়
ছাতিমতলা পর্ব ৩৯: তেমন মাতৃসাহচর্য পাননি বলেই নৈর্ব্যক্তিকভাবে মা-সন্তানের সম্পর্ককে দেখতে পেরেছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ৩৮: রবি ঠাকুরের জন্মদিনের সাংস্কৃতিক ‘ফ্যাশন’ নিয়ে ফুট কাটা যাবে না কেন!
ছাতিমতলা পর্ব ৩৭: রবীন্দ্রনাথের মতে, ভোট সামাজিক মঙ্গলের নিঃশর্ত উপায় নয়
ছাতিমতলা পর্ব ৩৬: টক্সিক রিলেশনশিপ কি রবীন্দ্রনাথের লেখায় আসেনি?
ছাতিমতলা পর্ব ৩৫: রবীন্দ্রনাথ কি আড্ডা মারতেন?
ছাতিমতলা পর্ব ৩৪: চিনের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের সভ্যতা-ভাবনা ছিল কল্পনা বিলাস
ছাতিমতলা পর্ব ৩৩: পুরস্কার মূল্যকে হেলায় ফেরাতে জানে কবিই, জানতেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ৩২: তরুণ রবির তীক্ষ্ণ সমালোচক পরিণত রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ৩১: ভোটের মঞ্চে উড়ছে টাকা, এসব দেখে কী বলতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ৩০: শিক্ষিত ভদ্রলোকের ‘নাগরিকত্ব’ বিষয়ক ভাবনার সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের যোগ তৈরি হচ্ছে না, বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ২৯: কলকাতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অপ্রেম রয়েছে যেমন, তেমনই রয়েছে আবছায়া ভালোবাসা
ছাতিমতলা পর্ব ২৮: মনের ভাঙাগড়া আর ফিরে-চাওয়া নিয়েই মধুসূদনের ভাষা-জগৎ– রবীন্দ্রনাথেরও
ছাতিমতলা পর্ব ২৭: বাংলা ভাষা কীভাবে শেখাতে চাইতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ২৬: ‘খানিক-রবীন্দ্রনাথ-পড়া’ প্রৌঢ়ের কথায় রবীন্দ্রনাথের প্রেম চেনা যাবে না
ছাতিমতলা পর্ব ২৫: সুকুমার রায় যে অর্থে শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জন করতে পারতেন, রবীন্দ্রনাথ তা পারেননি
ছাতিমতলা পর্ব ২৪: বিশ্বভারতীর ছাপাখানাকে বই প্রকাশের কারখানা শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথ দেশগঠনের ক্ষেত্রেও কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ২৩: ধর্মবোধের স্বাধিকার অর্জনের কথা মনে করিয়ে দিয়েও রবীন্দ্রনাথ দেশের মানুষের সাম্প্রদায়িক মনকে মুক্ত করতে পারেননি
ছাতিমতলা পর্ব ২২: রামায়ণে রাম-রাবণের যুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল গৌণ বিষয়
ছাতিমতলা পর্ব ২১: রবীন্দ্রনাথ পড়ুয়াদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতেন, চাঁদের আলোয় গান গাইতেন
ছাতিমতলা পর্ব ২০: সুভাষচন্দ্র বসুকে তীব্র তিরস্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ!
ছাতিমতলা পর্ব ১৯: আবেগসর্বস্ব ধর্ম ও রাজনীতির বিরোধিতা করে অপ্রিয় হয়েছিলেন
ছাতিমতলা পর্ব ১৮: রবীন্দ্রনাথ কখনও গীতাকে যুদ্ধের প্রচারগ্রন্থ হিসেবে বিচার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১৭: ক্রিকেটের রাজনীতি ও সমাজনীতি, দু’টি বিষয়েই তৎপর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথ কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর কিংবা কপি এডিটিং করার চাকরি পেতেন?
ছাতিমতলা পর্ব ১৫: কবি রবীন্দ্রনাথের ছেলে হয়ে কবিতা লেখা যায় না, বুঝেছিলেন রথীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ১৪: ছোট-বড় দুঃখ ও অপমান কীভাবে সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ?
ছাতিমতলা পর্ব ১৩: পিতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা রেণুকার স্বাধীন মনের দাম দেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১২: এদেশে ধর্ম যে চমৎকার অস্ত্রাগার, রবীন্দ্রনাথ তা অস্বীকার করেননি
ছাতিমতলা পর্ব ১১: কাদম্বরীকে বঙ্গজ লেখকরা মুখরোচক করে তুলেছেন বলেই মৃণালিনীকে বাঙালি জানতে চায়নি
ছাতিমতলা পর্ব ১০: পাশ্চাত্যের ‘ফ্যাসিবাদ’ এদেশেরই সমাজপ্রচলিত নিষেধনীতির প্রতিরূপ, বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ছাতিমতলা পর্ব ৯: দেশপ্রেম শেখানোর ভয়ংকর স্কুলের কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এমন স্কুল এখনও কেউ কেউ গড়তে চান
ছাতিমতলা পর্ব ৮: অসমিয়া আর ওড়িয়া ভাষা বাংলা ভাষার আধিপত্য স্বীকার করে নিক, এই অনুচিত দাবি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও
ছাতিমতলা পর্ব ৭: বাঙালি লেখকের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ ভগবান কিংবা ভূত হচ্ছেন, রক্তমাংসের হয়ে উঠছেন না
ছাতিমতলা পর্ব ৬: যে ভূমিকায় দেখা পাওয়া যায় কঠোর রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৫: চানঘরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেও আপত্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথের
ছাতিমতলা পর্ব ৪: যে রবীন্দ্র-উপন্যাস ম্যারিটাল রেপের ইঙ্গিতবাহী
ছাতিমতলা পর্ব ৩: ‘রক্তকরবী’র চশমার দূরদৃষ্টি কিংবা সিসিটিভি
ছাতিমতলা পর্ব ২: ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ বনাম ‘রবীন্দ্র-কৌতুক’
ছাতিমতলা পর্ব ১: ‘ডাকঘর’-এর অমলের মতো শেষশয্যা রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু পাননি
মজার বিষয়, শ্যাম বেনেগাল যখন হঠাৎই 'বোস: দ্য ফরগটেন হিরো' বানাচ্ছেন, এনডিএ আমলের শেষ ও ইউপিএ আমলের শুরুর আবহে, তার আশপাশে ভগৎ সিংয়ের গোটা দুই বায়োপিক মুক্তি পেয়ে গেছে, একটিতে নায়ক অজয় দেবগণ, অন্যটিতে সানি দেওল। অজয় দেবগণ অভিনীত বায়োপিকটিই বেশি স্মর্তব্য হয়ে রইল, সানি দেওলের 'ঢাই কিলো কা হাত' এক্ষেত্রে অকেজো হয়ে গেল।