১৯৭১-এ প্রকাশিত হল ফ্রেডরিক ফোরসাইথের ‘দ্য ডে অফ দ্য জ্যাকল’। বেরিয়েই সুপারহিট! ৩০টি ভাষায় অনুবাদ বেরিয়ে গেল। সারা পৃথিবী জুড়ে বিক্রি। এমন পলিটিক্যাল থ্রিলার আগে নাকি লেখাই হয়নি। সিনেমাও তৈরি হল। রাতারাতি ফ্রেডরিক ধনীতম ইংরেজদের একজন। পরের বছর প্রকাশিত হল ফ্রেডরিক এর ‘দ্য ওডেসা ফাইল’। আবার সুপারহিট! এবং পৃথিবীতে দেখা দিল একটা নতুন নেশা। ফ্রেডরিক-আচ্ছন্নতা!
৪৫.
খাঁটি ইংরেজ, ফ্রেডরিক ফোরসাইথ। বেশ চলছিল জীবন। টর্ন ব্রিজ স্কুল থেকে পাশ করে বেরবার পরেই রয়েল এয়ার ফোর্সে পাইলটের চাকরি পেয়ে গেল। সিঙ্গেল ইঞ্জিন ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান ওড়াচ্ছে ১৮ বছরের ফ্রেডরিক। এর থেকে ভালো কাজ পৃথিবীতে আছে নাকি? কিন্তু ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮– দু’-বছরের বেশি কাজটা থাকল না!
এখন কী করা যাবে? বাবাকে জিজ্ঞেস করে মনমরা ফ্রেডরিক। বাবা ছেলেকে হতাশ হতে বারণ করে বলেন, ‘তোর তো পৃথিবী ঘোরার ইচ্ছে। রিপোর্টারের চাকরি খোঁজ। সাংবাদিক হতে পারলে সারা পৃথিবী ঘোরার সুযোগ পাবি।’
রয়টার্সের সাংবাদিক হয়ে গেলাম। এবং চার বছরের মধ্যে পৃথিবীর কত দেশে যে কত অভিজ্ঞতা হল! কত অপরাধ, কত ষড়যন্ত্র, কত খুন, পলিটিক্যাল হত্যা– এসব দেখতে লাগলাম। তারপর বিবিসিতে চাকরি। ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট। এবং সেই চাকরিও চলে গেল। এবার? চাকরি নেই। ধার বাড়ছে। পাওনাদারের তাগাদাও বাড়ছে! ফ্রেডরিক অসহায়।
এদিকে দরজায় বেজে চলেছে জেদি বেপরোয়া কলিং বেল! ফ্রেডরিক ছুটে যায় দরজার দিকে। যদিও সে জানে না দরজা খুলে পাওনাদারকে কী বলবে। কিন্তু দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না ফ্রেডরিক ফোরসাইথ। তাঁর লেখার টেবিল তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়! ফ্রেডরিক পড়তে পড়তে বলে– ফাক্ ইউ! এই আদি উচ্চারণ করে কার উদ্দেশে? পাওনাদারের? না টেবিলের?
কলিংবেল এক সময় থেমে যায়। ফ্রেডরিক পড়ে গিয়ে মুখ থুবড়ে শুয়েছিল। কলিংবেল থামতে সে উঠে ধীরে ধীরে লেখার টেবিলটার সামনে চেয়ারে গিয়ে বসল। তারপর বলল, আমি দরজা খুলতে যাচ্ছিলাম, ল্যাং মেরে ফেলে দিলে কেন?
– ওই দরজা খুললে তুমি পালাবার পথ পেতে না। তোমাকে অন্য দরজা খুলতে হবে।
– অন্য দরজা?
– হ্যাঁ, সময় এসেছে। আমার বুকের ওপর ফ্রেডরিক, আমি ধরে আছি তোমার ভবিষ্যৎ। তোমার ফিউচার রচনা করবে তুমি, ফ্রেডরিক, তুমি, আমার বুকের ওপর একটি উপন্যাস লিখে। উপন্যাসের বিষয় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট শার্লস ডে গল-এর হত্যা!
– কী বলছ তুমি? টেবিলের গায়ে জোরে থাপ্পড় মেরে বলে অবাক ও উত্তেজিত ফ্রেডরিক।
– যা বলছি শোনো। ফ্রেডরিক, তোমাকে লিখতে হবে একটা পলিটিক্যাল থ্রিলার। এই রকম রাজনৈতিক থ্রিলার কেউ লিখতে পারেনি। এই থ্রিলারের কেন্দ্রে থাকবে একজন পেশাদার কিলার। যাকে একটা বিরোধী ফ্রেঞ্চ প্যারামিলিটারি অর্গানাইজেশন ভাড়া করবে বহু টাকা দিয়ে ডে গলকে হত্যা করার জন্য। বাকিটা ছেড়ে দিচ্ছি তোমার কল্পনার ওপর।
টেবিলের এই কথা শোনার পরে হতবাক ফ্রেডরিক জানতে চায়, এই উপন্যাস লিখে আমার হবেটা কী?
– অর্থের বন্যা আসবে তোমার জীবনে!
– কত টাকা?
– তার হিসেব রাখা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। লিখতে শুরু করো ফ্রেডরিক। দেরি কোরো না। তবে উপন্যাসের নামটি কিন্তু জবরদস্ত হওয়া চাই।
– টেবিল, এতই যখন বললে, নামটাও বলো।
– THE DAY OF THE JACKAL, বলল টেবিল।
দারুণ নাম, প্রথমেই মনে হল ফ্রেডরিকের। জ্যাকল তো আফ্রিকার বুনো ভয়ংকর শিকারি কুকুর। তারপর ‘জ্যাকল’ শব্দটার অব্যর্থ দ্বিতীয় অর্থটা দুম করে মনে পড়ে গেল। নাকি, টেবিলটা বলে দিল, ফ্রেডরিক, ‘জ্যাকল’ হল সেই মানুষ যে অন্যের জন্যে টাকা নিয়ে অপরাধ করে, যেমন সুপারি কিলার। তোমার উপন্যাসের সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার কোড-নামে পরিচিত হবে। কোড-নেম জ্যাকল।
ফ্রেডরিক বিস্ময়ে তাকিয়ে টেবিলটার দিকে। টেবিলটা আর কাঠের নয়। জীবন্ত কথার। ফ্রেডরিক শুনতে পায় টেবিল বলছে, ফ্রেডরিক, তুমি সারা পৃথিবীর অপরাধ জগতের ভেতরটা দেখেছ। এবার সেই জ্ঞান কাজে লাগাও। জাল পাসপোর্ট তৈরি, কত সহজে হয়, তোমার থেকে ভালো কে জানে? কাজে লাগাও তোমার সেই জ্ঞানের ভাণ্ডার। এমন লেখা লেখো যে লেখা শুধু লিখতে পারে একজন পেশাদার খুনি।
না না, আমি পারব না। সেটা তো সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হবে, লোকে আমাকে কী ভাববে? ফ্রেডরিকের ভেতরটা চিৎকার করে ওঠে। আর তক্ষুনি তার লেখার টেবিলের বুকে ফুটে ওঠে মস্ত বড় এক প্রাসাদ, দারুণ দামি গাড়ি, বিশাল সম্পদ আর পাউন্ডের স্রোত, এত অর্থ রাখবে কোথায় ফ্রেডরিক?
একদিন এক বন্ধু হয়তো কিঞ্চিৎ বিদ্রুপ করেই জানতে চাইল, ‘তোমার অর্থনৈতিক সুরাহার জন্য কী করবে ভাবছ?’ প্রশ্নের উত্তরে ফ্রেডরিক বলল, ভাবছি একটা উপন্যাস লিখব। বন্ধু হেসে বলল, ‘তার চেয়ে ব্যাংক ডাকাতি করো। সহজে তাড়াতাড়ি বড়লোক হবে।’
১৯৭১-এ প্রকাশিত হল ফ্রেডরিক ফোরসাইথের ‘দ্য ডে অফ দ্য জ্যাকল’। বেরিয়েই সুপারহিট! ৩০টি ভাষায় অনুবাদ বেরিয়ে গেল। সারা পৃথিবী জুড়ে বিক্রি। এমন পলিটিক্যাল থ্রিলার আগে নাকি লেখাই হয়নি। সিনেমাও তৈরি হল। রাতারাতি ফ্রেডরিক ধনীতম ইংরেজদের একজন। পরের বছর প্রকাশিত হল ফ্রেডরিক-এর ‘দ্য ওডেসা ফাইল’। আবার সুপারহিট! এবং পৃথিবীতে দেখা দিল একটা নতুন নেশা। ফ্রেডরিক-আচ্ছন্নতা! একটার পর একটা থ্রিলার আমাদের গিলে ফেলল: ‘দ্য ডগস অফ ওয়ার’, ‘দ্য ফিস্ট অফ দ্য গডস’, ‘দ্য আফগান’, ‘নো কামব্যাকস’। ২০১৮ সালে ফ্রেডরিক লিখল শেষ দু’টি বই, ‘মাই লাইফ ইন ইন্ট্রিগ’ এবং ‘দ্য ফক্স’।
দ্বিতীয় স্ত্রী স্যান্ডি মোলির বারণ, ‘অনেক বুড়ো হয়ে গেছ, এত পরিশ্রম আর কোরো না। লেখা ছাড়ো। তোমার শরীরের জন্য সারাক্ষণ ভয় করে আমার। আমাদের তো আর টাকার দরকার নেই। ৪২টা ঘরের বাড়িতে আমরা থাকি। তুমি না থাকলে আমার অবস্থা কী হবে বলত?’
৪২টা ঘরের বাড়িতে ফ্রেডরিককে একলা ফেলে গত বছর শেষ হল মোলির জীবন। সেই একাকিত্ব বেশিদিন সহ্য করতে হল না ফ্রেডরিককে। ৯ জুন ৮৭ বছর বয়েসে ফ্রেডরিক ফোরসাইথের জীবনে পর্দা নামে। এবং মোটামুটি শেষ হিসেব এই দাঁড়িয়েছে: এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবী জুড়ে ফ্রেডরিকের ৮ কোটি বই বিক্রি হয়েছে। ডলার এবং পাউন্ডের হিসেবে টাকায় অঙ্কটা কোথায় দাঁড়াতে পারে ভেবে দেখতে পারেন। শুনেছি, জীবনে পরিবর্তন পছন্দ করেও লেখার টেবিল কোনওদিন বদলানোর কথা ভাবতে পারেননি ফ্রেডরিক!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৪৪: আম-বাঙালি যেভাবে আমকে বোঝে, দুই আমেরিকান লেখিকা সেভাবেই বুঝতে চেয়েছেন
পর্ব ৪৩: দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে মা দৌড়ে বেরিয়ে গেল, ইবতিসম্-এর উপন্যাসের শুরু এমনই আকস্মিক
পর্ব ৪২: অন্ধকার ভারতে যে সিঁড়িটেবিলের সান্নিধ্যে রামমোহন রায় মুক্তিসূর্য দেখেছিলেন
পর্ব ৪১: বানু মুশতাকের টেবিল ল্যাম্পটির আলো পড়েছে মুসলমান মেয়েদের একাকিত্বের হৃদয়ে
পর্ব ৪০: গোয়েটের ভালোবাসার চিঠিই বাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের সুইসাইড প্রবণতা
পর্ব ৩৯: লেখার টেবিল বাঙালির লাজ ভেঙে পর্নোগ্রাফিও লিখিয়েছে
পর্ব ৩৮: বঙ্গীয় সমাজে বোভেয়ার ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর ভাবনার বিচ্ছুরণ কতটুকু?
পর্ব ৩৭: ভক্তদের স্তাবকতাই পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র-কীর্তি স্থায়ী হতে দেয়নি, মনে করতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী
পর্ব ৩৬: একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে মারিও ভার্গাস লোসা যেন ছবি বিশ্বাস!
পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি
পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল