আকাশের পানে তাকালেই আজকাল একটি ভাবনা আসে মনে। পাশাপাশি দু’টি তারা। ঝিলমিল করছে। পরস্পরের মাত্র কয়েক হাত দূরে। যেন কত ভাব ভালোবাসা ওদের মধ্যে। অথচ আমি জানি ওদের মাঝখানে বিছিয়ে কত আলোকবর্ষের দূরত্ব! ওরা পরস্পরকে চেনে না। জানে না। হয়তো দেখতেও পায় না। অথচ আমার থেকে ওদের দূরত্ব ওদের পরস্পরকে কাছে নিয়ে এসেছে। দূরত্ব তৈরি করেছে এই দৃষ্টির ভ্রান্তি।
৪৭.
এই লেখাটা একটু দলছুট। বেমানান। বেয়াড়া। বিতিকিচ্ছিরি। আমি ক’দিন যাতনায় আছি। শরীরের। মনের। আত্মার। সুতরাং, এই অবস্থায় সদ্যপ্রসূত লেখা বেয়াড়া হতেই পারে। তার ওপর আমার লেখার টেবিলটা লেখা শুরু করতেই দুম করে প্রশ্ন করল, ‘কী লাভ শুরু করে যখন শেষ করতেই হবে?’
প্রশ্নটা ধাক্কা দিল। এবং জাগাল আরও একটি জরুরি প্রশ্ন, শেষ বলে কিছু কি থাকতে পারে যদি না থাকে শুরু? এই প্রশ্ন থেকে আর কত পা দূরে এই পরিপ্রশ্ন উঠবে, এই মহাবিশ্বে যদি শেষ বলে কিছু না থাকে, তাহলে শুরুর কোনও ভাবনা আমরা কি আদৌ ভাবতে পারি?
এই বিদঘুটে ভাবনা আমার নয়। আমার টেবিলটার নয়। বহু বছর আগে তাঁর ‘ফিলোজফিকাল রাইটিংস’-এ লিখেছিলেন সিমোন দ্য বোভোয়া: “What’s the use of starting if you must stop?”
সিমোনের এই ভাবনার লেজ ধরে একেবারে সম্প্রতি জার্মান দার্শনিক ওলফ্রাম আইলেনবার্গার কোথায় এসে পৌঁছলেন দেখুন: “the tension between one’s own finite existence and the obvious infinity of the world. After all, it took only a moment’s contemplation of this abyss for every plan, every design, every self-appointed goal– be it conquering the globe or mere gardening– to be abandoned to absurdity.”
‘এইবার এই ভাবনার বিপুলতাটা ভেবে দ্যাখ তুই’, বলল আমার লেখার টেবিল বেয়াড়া ইঙ্গিতে। যত আসছি আমার জীবনের শেষের দিকে, ততই যেন একটা অন্তর্নিহিত টেনশন টের পাচ্ছি। টেনশনটা আমার সীমিত জীবন, আর ক’দিনই বা আছি এই পৃথিবীতে– এই ভাবনা এবং এই মহাবিশ্বের সীমাহীনতা, এই দুটোর মধ্যে একটা টেনশন আছেই। এবং ক্রমশ এই টেনশন বা উদ্বেগটা তীব্র হচ্ছে– যত আসছি দড়ির অন্তে। এই মহাবিশ্ব, মহাকাশ, অন্তহীন নক্ষত্রবীথি, সমুদ্র, অরণ্য, পর্বতমালা, কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়, আটলান্টিকে সূর্যাস্ত– সব থেকে যাবে। সেই অন্তহীন থেকে যাওয়ার তুলনায় কী বিন্দুসম আমার অস্তিত্ব, কী অর্থহীন, উপহাস্য আমার জীবনের জোনাকি– ক্ষণিকতা!
আকাশের পানে তাকালেই আজকাল একটি ভাবনা আসে মনে। পাশাপাশি দু’টি তারা। ঝিলমিল করছে। পরস্পরের মাত্র কয়েক হাত দূরে। যেন কত ভাব-ভালোবাসা ওদের মধ্যে। অথচ আমি জানি, ওদের মাঝখানে বিছিয়ে কত আলোকবর্ষের দূরত্ব! ওরা পরস্পরকে চেনে না। জানে না। হয়তো দেখতেও পায় না। অথচ আমার থেকে ওদের দূরত্ব ওদের পরস্পরকে কাছে নিয়ে এসেছে। দূরত্ব তৈরি করেছে এই দৃষ্টির ভ্রান্তি। এই মহাবিশ্বের বিপুলতার কোনও ধারণা ছাড়া, হাজার হাজার ইলিউশনকে সত্য বলে জেনে যে বিন্দুতে শুরু করেছিলাম, সেই বিন্দুতেই শেষ, প্রান্ত জীবনে মনে হচ্ছে জীবন কী অর্থহীনভাবে ছোট! লিখছেন আইলেনবার্গার: “In the end, it all boiled down to the same thing. Even if no one else did, time itself would ensure that whatever work one had done came to nothing, consigning it to eternal oblivion. Exactly as if it had never existed. A fate as certain as one’s own death.”
জার্মান দার্শনিকের জীবন দর্শনের শেষ কথাটা হল, শেষপর্যন্ত তুমি যা কিছু করলে, মনে হল এই তো তোমার সোনার ধান, তোমার জীবনভর শ্রমের ফসল, সবকিছুর একটাই অর্থ, তুমি বাগান করলেও যা, পৃথিবী জয় করলেও তা-ই, মহাকাল গ্রাস করবে সব কিছু। এবং তুমি তলিয়ে যাবে বিস্মৃতির সমুদ্রে। ‘Time itself would ensure that whatever work one had done came to nothing, consigning it to external oblivion.’ যেন তুমি ছিলেই না কোনওদিন। তোমার অস্তিত্বের কোনও চিহ্নও থাকবে না। এই হল এই মহাবিশ্বের শেষ অমোঘ সত্য। কতদূর অমোঘ, তাও জানতে চাও? ‘A fate as certain as one’s own death.’
আমি এতদূর লেখার পর চুপ। নিথর। কী লিখব? কী লাভ লিখে? কিচ্ছু থাকবে না, যা কিছু ভাবতে পারি, লিখতে পারি, আমার সব পরিশ্রম ও প্রকাশ অর্থহীন। যে এক বিন্দু জীবন এখনও অবশিষ্ট, সেটুকুকে কি কাফকার হাতে ছিঁড়ে ফেলা প্রেমের চিঠির মতো অন্ধকারে উড়িয়ে দেব? আমার লেখার টেবিল, কী অসীম দয়া তার, আকস্মিক তারল্যে ঢুকে পড়ল আমার স্মৃতির স্রোতে। আর জ্বলে উঠল আলো। মনে পড়ে গেল, সিমোনের দার্শনিক প্রবন্ধগুচ্ছ থেকে উঠে আসা তিনটি অপরূপ প্রশ্ন: ‘What, then, is the measure of a man? What goals can he set for himself and what hopes are permitted him?’
এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর সারা জীবন সন্ধান করেছেন সিমোন। এই তিনটি প্রশ্নই গড়ে তুলেছে তাঁর নিজস্ব জীবনদর্শনের কাঠামো। এবং এই তিনটি প্রশ্নের সংশয়-আচ্ছন্ন উত্তর তৈরি করেছে সিমোনের যাপন-ভাবনার সারাৎসার। আমার শেষ যাপনবিন্দুর আশ্রয়ও সিমোনের সন্ধান, সংশয় ও মেঘলা বিশ্বাস।
জানুভ্রষ্ট আমি গত আগস্টে প্যারিসে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম প্যারিসের একেবারে কেন্দ্রে ‘Cafe de Flore’-এর সামনে, সিমোনকে স্মরণ করে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সিমোন এই ক্যাফের দোতলায় কাচের জানলার পাশে চুপ করে বসে রাস্তার পথিকদের দেখতেন। কী দেখতেন তিনি? যা আমরা দেখি না। দেখতে জানি না। মনে পড়ে গেল সিমোনের লেখা। যে টেবিলে লিখছি, সেই টেবিলেই তো সিমোনের এই লেখা পড়েছি:
‘From my corner table on the second floor of the Cafe de Floore, I observed the passersby. There they walked. The others. Each one a private consciousness. All moving about with their own concerns and anxieties, their plans and hopes. Exactly, as I did myself. Just one among billions. The thought sent shivers down my spine every time.’
ক্যাফের দোতলার জানলা দিয়ে আমি দেখতে পাই, কত মানুষ হেঁটে চলেছে। সবাই নিজের নিজের সমস্যা, পরিকল্পনা, স্বপ্ন নিয়ে একা। ওরা হল ‘অন্যরা’, আমিও আমার নিজস্ব সমস্যা ও স্বপ্নে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে একা। আমরা প্রত্যেকেই যেন পৃথক পৃথক চেতনা ও যন্ত্রণার দ্বীপ। আমি জানি সার্ত্রে কী করছে। “He is so desperate. We are in the spring of 1943 and at the climax of another world war and in the middle of an occupied city. Because of ration cards and food shortages and chronic withdrawals from coffee and tobacco, by now Sartre was so desperate that he crawled around every morning on the floor of the Cafe collecting the previous evening’s stubs.”
বিপুল এই দার্শনিকের হাজার পাতার বিখ্যাত বই ‘Being and Nothingness’ ইতিমধ্যে ছাপা হচ্ছে। আর সেই দার্শনিক, ক্যাফের মেঝেতে রোজ সকালে হামাগুড়ি দিয়ে ফেলে দেওয়া সিগারেটের শেষ টুকরো জড়ো করেন নিজে তামাকের খিদে মেটাবেন বলে! সিগারেটের এত চড়া দাম কিনতে পারেন না। তবু সিমোন এই দার্শনিকের সঙ্গেই সহবাস করেন প্যারিসের এক অতি সস্তার হোটেল ঘরে। তাঁদের এই সম্পর্কের মরমি মাহাত্ম্য কোথায়? জানাচ্ছেন সিমোন নিজেই: ‘It is a love pact of an original kind. We have promised each other unconditional intellectual fidelity and honesty– with an openness to other attractions.’
এরপর, ১৯৪৩ সালে, আমদের এই ঠুনকো এবং তঞ্চক আধুনিকতা থেকে কত দূরে কী অপূর্ব সাহস ও সততা দেখিয়ে সিমোন করতে পেরেছিলেন এই স্বীকারোক্তি: ‘We would be absolutely necessary to each other, but also at times to others.’
আমরা পরস্পরের কাছে চিরদিন অতীব প্রয়োজনীয় থাকব। কিন্তু অন্যদের জন্যেও খোলা রাখব দরজা। কখনও কখনও।
এইভাবেই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা সম্পর্কের তাৎপর্য, তাপ। মিথ্যাচারের খড়ের গাদায় হারিয়ে ফেলেননি প্রেমের চিকনবিন্দু।
আমার প্রান্ত জীবনের শ্রান্ত সন্ধ্যায় এই সত্যের দীপনটুকু আগলে রাখলাম পরম প্রাপ্তির প্রত্যয়ে। এই বিয়ে না করা ভুবনভরানো দীপিত দম্পতিকে যত পড়েছি, গেছি তাদের দহনে ও সহনে, ভালোবেসেছি তত!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৪৬: যে টেবিলে দেবদূত আসে না, আসে শিল্পের অপূর্ব শয়তান
পর্ব ৪৫: ফ্রেডরিক ফোরসাইথকে ফকির থেকে রাজা করেছিল অপরাধের পৃথিবী
পর্ব ৪৪: আম-বাঙালি যেভাবে আমকে বোঝে, দুই আমেরিকান লেখিকা সেভাবেই বুঝতে চেয়েছেন
পর্ব ৪৩: দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে মা দৌড়ে বেরিয়ে গেল, ইবতিসম্-এর উপন্যাসের শুরু এমনই আকস্মিক
পর্ব ৪২: অন্ধকার ভারতে যে সিঁড়িটেবিলের সান্নিধ্যে রামমোহন রায় মুক্তিসূর্য দেখেছিলেন
পর্ব ৪১: বানু মুশতাকের টেবিল ল্যাম্পটির আলো পড়েছে মুসলমান মেয়েদের একাকিত্বের হৃদয়ে
পর্ব ৪০: গোয়েটের ভালোবাসার চিঠিই বাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের সুইসাইড প্রবণতা
পর্ব ৩৯: লেখার টেবিল বাঙালির লাজ ভেঙে পর্নোগ্রাফিও লিখিয়েছে
পর্ব ৩৮: বঙ্গীয় সমাজে বোভেয়ার ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর ভাবনার বিচ্ছুরণ কতটুকু?
পর্ব ৩৭: ভক্তদের স্তাবকতাই পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র-কীর্তি স্থায়ী হতে দেয়নি, মনে করতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী
পর্ব ৩৬: একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে মারিও ভার্গাস লোসা যেন ছবি বিশ্বাস!
পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি
পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল