আসমানি পাঞ্জাবি চিৎকার করতে লাগলেন– ‘আমাদের মধ্যে এসে গেছেন, এই বাংলা, তথা ভারত, তথা এই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এক মহাকবি, যিনি শব্দ দিয়ে জব্দ করেন মানুষর হৃদয়, যার কবিতা কম্পিটিশনে সবাই বলে ফার্স্ট হয়, সেই ভালবাসার কবি, প্রাণের কবি, বাংলার কবি শ্রীশঙ্খ ঘোষকে আমি মঞ্চে এসে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।’ পুরো ব্যাপারটা এমন একটা স্পিডে ঘটল যে, কিছু করারই ছিল না প্রায়। হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক! শঙ্খবাবু একবার আমার আর একবার চন্দ্রিলের দিকে চাইলেন।
৩৩.
সুনীলদা রেগে আছেন কেন? কী ভুল করলাম আমরা? সারারাত জেগে কলকাতা ফেরার ধকল, ক্যাসেট রিলিজের টেনশন– মাথায় কিচ্ছুই ঢুকছে না তখন। একরাশ ভয় নিয়ে ফোন করলাম। সুনীলদার ‘হ্যালো’ শোনার পর আরও ভয় ভয় করছে।
কোনওমতে বললাম, ‘সুনীলদা, আমাদের তরফে কী কোনও গাফিলতি হল?’
সুনীলদা বললেন, ‘কী কাণ্ড! কে বলেছে এসব, জয়দেব?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘আসলে আজকে তো যাব ঠিক করে রেখেছিলাম। ডায়েরিতেও লেখা ছিল। কিন্তু কাগজের বিজ্ঞাপনে দেখলাম, তোমরা শঙ্খের নামটা দিয়েছ, আমার নামটা দাওনি। ফলে যাওয়াটা ভালো দেখায় না।’
সর্বনাশ করেছে! সুনীলদার অভিমান হয়েছে নাম না-দেওয়ায়।
আমি কোনওমতে বললাম, ‘সুনীলদা, আপনি তো কনফার্ম করেননি, আমরাই বুঝতে পারিনি যে আসবেন। আপনি প্লিজ আসুন।’
সুনীলদা চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, ‘এবারটা ছেড়েই দাও, পরে কখনও হবে।’
ফোনটা রেখে দেওয়ার পর প্রচণ্ড মনখারাপ হল। সুনীলদা এলে, অনুষ্ঠানটা অন্য মাত্রা পেত। চন্দ্রিলকে ফোন করে বললাম, পুরোটা। ও জানাল, শঙ্খবাবুকে আনতে বেরচ্ছে এইবার। কোনও গোলমাল যেন না হয়। সুনীলদার ব্যাপারটা ভালো হল না মোটেই। জয়দেব শুধু শঙ্খবাবুকে বলেই ক্ষান্ত হয়নি, আরও একটা উপকার করেছিল। কলকাতার লিকার ব্যবসায়ী, বাংলা কবিতার পৃষ্ঠপোষক তরুণ চট্টোপাধ্যায়কেও বলেছিল, একটা পার্টির আয়োজন করতে। কারণ, নিয়ম হচ্ছে, সাংবাদিকদের ফ্রি-তে মদ খাওয়াতে হয়। কোনওমতে স্নান সেরে, আমি তড়িঘড়ি পৌঁছই ‘মিউজিক ওয়ার্ল্ড’। সেখানে গিয়ে দেখি আরেক কীর্তি! গান যে গাইব, তার উপায় নেই। কারণ সাউন্ড বলা হয়নি। তখন মিউজিক ওয়ার্ল্ড দেখাশুনা করতেন দেবরাজদা বলে একজন। তিনি বলছেন, আশা অডিও জানায়নি, ওদিকে মহুয়া বলছে, দেবরাজদা বোঝেননি। এই চাপানউতোরে একটা ব্যাপার পরিষ্কার– গান গাওয়া যাবে না আজ।
যখন পৌঁছেছি, তখনই ভালো ভিড় মিউজিক ওয়ার্ল্ডে। এমনি মানুষ তো আছেই, চেনা-পরিচিত সাংবাদিকরাও ঘোরাঘুরি করছে। রয়েছে আনন্দবাজারের খুব নামকরা ফোটোগ্রাফার অশোক মজুমদার। অশোকদা আমার কাছে এসে বলল, ‘খবরটা পাকা তো?’
‘কোন খবর?’
‘শঙ্খ ঘোষ আসার খবর।’
আমি মাথা নাড়লাম।
অশোকদা পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘কী করেছ তোমরা! শঙ্খ ঘোষ মিউজিক ওয়ার্ল্ডে– ভাবা যায়!’
এর মধ্যেই অরূপ এসে বলল, ‘ঋতুদা চলে এসেছে কিন্তু।’ সে কী! এখনও তো অনুষ্ঠান শুরু হতে আধঘণ্টা বাকি! রাস্তায়, অনুষ্ঠানের দেরি আছে শুনে উল্টোদিকে আবিষ্কার শপ-এ ঢুকে গেল। বোঝা গেল ঋতুদা পাংচুয়াল নয়, সময়ের অনেক আগে চলে এসেছে।
‘চ’ অ্যালবাম একটা আস্ত গান গেয়েছে সোনা। ‘ভেসে যায় আদরের নৌকো।’ সেদিন গাওয়ার কথা ওঁর। চুপ করে এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। সোনাকে দেখে আরও খারাপ লাগাটা বাড়ল। বেচারি জানেই না, সাউন্ডের গোলযোগে আজ আর গান করা হবেই না। চ-এর একটা অনবদ্য কভার ডিজাইন করেছিল উপল। গোটা মিউজিক ওয়ার্ল্ড সেই কভার দিয়েই ব্যানারে মোড়া। লাহিড়িদা, মহুয়া আমাকে ডেকে নিয়ে গেল এককোণে। প্রথম দেখা ‘চ’-এর ক্যাসেট। এই তুমুল ডামাডোলের মধ্যেও একটুকরো হাসি এল মুখে। এই অ্যালবামটার জন্যই তো এত কিছু আড়ম্বর, যদি মানুষ একটু শোনে, যদি পুজোর প্যান্ডেলে বাজে আমাদের গান। মহুয়া আলাপ করিয়ে দিল আসমানি রং-এর পাঞ্জাবি পরা এক মানুষের সঙ্গে। উনিই আজকের অ্যাঙ্কার।
একটু থতমত খেলাম। অ্যাঙ্কার কেউ থাকবে, জানা ছিল না। ভেবেছিলাম, আমি আর চন্দ্রিল মিলেই হয়ে যাবে ব্যাপারটা। অ্যাঙ্কর ভদ্রলোক একটা চেয়ারে বসে চুকচুক করে চা খাচ্ছেন। আমায় দেখে বহরে চওড়া একটা হাসি দিলেন। ‘কী যে ভাল করলেন। আপনাদের প্রোগ্রামের জন্য আজ কতদিন বাদে শঙ্খদার সঙ্গে দেখা হবে।’
বাক্যটা শুনে একটু আশঙ্কার ছায়া ঘনাল মনে। তড়িঘড়ি বললাম, ‘শুনুন, ওঁকে কিন্তু মঞ্চে ডাকবেন না, বারণ করে দিয়েছেন।’
ভদ্রলোক চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আমাদের কতকালের চেনা জানেন?’
এমন গা জ্বলে যাওয়া প্রশ্নে মাথাটা আরও গরম হল। ‘হতে পারে আপনাদের জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক, কিন্তু ওঁকে স্টেজে ডাকবেন না প্লিজ!’
এইসবের মধ্যে কখন দেখি, ঋতুদা। ‘কী রে, শুরু কর।’
‘আর কেউ আসেনি যে।’
‘মমোদি ঢুকছে, কথা হল। আমি আর মমোদি শুরু করে দি’, শঙ্খদা চলে আসবেন।’
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
বলতে বলতেই মমোদি হাজির। মিউজিক ওয়ার্ল্ডের একচিলতে স্টেজে শুরু হয়ে গেল রিলিজ প্রোগ্রাম। অ্যাঙ্কর ভদ্রলোক ‘চন্দ্রবিন্দু’ নাম নিয়ে রসিয়ে-রসিয়ে কীসব বলছিলেন। আমার সবটা মাথায় না ঢুকলেও রাগ হচ্ছিল লোকটার ওপর। এত কথা বলার কী আছে! ঋতুদা হাতে মাইক তুলে নিল। চন্দ্রবিন্দু-র গান প্রথম শোনার গল্প বলতে শুরু করল। সামনের সারিতে ফোটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশবাল্ব, সদ্য গজানো টিভি সাংবাদিক– এমন জমকালো একটা পরিবেশে প্রচণ্ড টেনশন হতে শুরু করল আমার। যদি ঋতুপর্ণ আর মমতাশঙ্কর– দু’জনেরই বলা শেষ হয়ে যায়, আর চন্দ্রিল শঙ্খবাবুকে নিয়ে না পৌঁছতে পারে? টেনশনের একটা বড় গুণ, মাথায় কিছু ঢোকে না।
আসমানি পাঞ্জাবি জিজ্ঞেস ফিসফিস করে, ‘ক্যাসেট প্রকাশ করার কথা বলি?’
আমি বললাম, ‘আগে মমোদি বলুক।’
মমতাশঙ্করের বলা হয়ে যাওয়ার পরও চন্দ্রিলরা পৌঁছল না। কী দুর্বিপাক! এবার? ঋতুদাকে বললাম, ‘তুমি আরও একটু কিছু বলো।’ সমস্যাটা বুঝতে পেরে ঋতুদা আবার বলতে শুরু করল কিছু। তখনই ওই থিকথিক ভিড়ের ভেতর প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন চন্দ্রিলের মুখ দেখতে পেলাম। আর শঙ্খবাবুকে। সমুদ্র যেমন ফাঁক হয়ে গিয়ে পথ করে দিয়েছিল মোজেসের, ভিড়ও তেমন পথ তৈরি করে দিল শ্বেতশুভ্র মানুষটার জন্য।
ঋতুদার হাত থেকে মাইকটা কেড়ে নিয়ে আসমানি পাঞ্জাবি চিৎকার করতে লাগলেন– ‘আমাদের মধ্যে এসে গেছেন, এই বাংলা, তথা এই ভারত, তথা এই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এক মহাকবি, যিনি শব্দ দিয়ে জব্দ করেন মানুষের হৃদয়, যার কবিতা কম্পিটিশনে সবাই বলে ফার্স্ট হয়, সেই ভালবাসার কবি, প্রাণের কবি, বাংলার কবি শ্রীশঙ্খ ঘোষকে আমি মঞ্চে এসে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।’
পুরো ব্যাপারটা এমন একটা স্পিডে ঘটল যে, কিছু করারই ছিল না প্রায়। হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক! শঙ্খবাবু একবার আমার আর একবার চন্দ্রিলের দিকে চাইলেন। যে-দৃষ্টির মধ্যে গুপ্ত ঘাতকের হাতে অজান্তে ছোরা খাওয়ার অনপনেয় ভর্ৎসনা ছিল। সর্বনাশ যা ঘটার ঘটে গিয়েছে! আমার আর চন্দ্রিলের একবার চোখাচুখি হল। মাথা এতটাই নিচু করে ছিলাম, খেয়ালও করিনি ঠিক কীভাবে শঙ্খবাবু এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩২। ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১। ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?