আমি প্রিমিয়ারের দিন ঋতুদাকে ফোন করে টিকিট চাইলাম। ‘কার জন্য?’ ‘কার জন্য আবার, আমার জন্য, ঢুকতে তো টিকিট লাগবে নাকি!’ ঋতুদা সিরিয়াস স্বরে বলল, ‘অনিন্দ্য, তুই এই ছবির একজন মূল চরিত্র মনে রাখিস, তোর ঢুকতে কেন টিকিট লাগবে?’ এই আশ্বাসবাণীতে ভুলে যথারীতি প্রিয়া-র সামনে গিয়ে থই পাচ্ছি না। গুচ্ছ গুচ্ছ লোক। তাদের হাতে বৈধ প্রবেশপত্র, আমি চোরদায়ে ধরা পড়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি এদিক-সেদিক।
৪৩.
‘শুভ মহরৎ’-এর শুরুটা একেবারে রকেট স্পিডে। রিলিজ করা মাত্রই হিট! ‘ঋতুপর্ণর প্রথম ডিটেকটিভ মুভি’– এই প্রচারটুকুই যথেষ্ট ছিল দেওয়াল লিখনে। বোঝাই যাচ্ছিল, ছবি দৌড়বে। সেই প্রথম কোনও প্রিমিয়ারে যাওয়া। ‘প্রিয়া’ সিনেমার সামনেটায় ফুল দিয়ে সাজানো। যতদূর মনে পড়ছে, শর্মিলা ঠাকুর আসতে পারেননি। রাখীদিকে ঘিরে মিডিয়ার উত্তেজনা।
আমি প্রিমিয়ারের দিন ঋতুদাকে ফোন করে টিকিট চাইলাম। ‘কার জন্য?’ ‘কার জন্য আবার, আমার জন্য, ঢুকতে তো টিকিট লাগবে নাকি!’ ঋতুদা সিরিয়াস স্বরে বলল, ‘অনিন্দ্য, তুই এই ছবির একজন মূল চরিত্র মনে রাখিস, তোর ঢুকতে কেন টিকিট লাগবে?’ এই আশ্বাসবাণীতে ভুলে যথারীতি প্রিয়া-র সামনে গিয়ে থই পাচ্ছি না। গুচ্ছ গুচ্ছ লোক। তাদের হাতে বৈধ প্রবেশপত্র, আমি চোরদায়ে ধরা পড়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি এদিক-সেদিক। উদ্ধার করল আমায় দাদুল, মানে প্রিয়া সিনেমার কর্ণধার– অরিজিৎ দত্ত। দেখি, ইশারা করছে আমায়, অন্য গেট দিয়ে ঢোকার জন্য। এমন যে একটা ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায়, সেটাই আমার কাছে খুব অবাক করা! স্পেশাল গেট দিয়ে সেই প্রথম ঢুকলাম প্রিয়াতে। স্মৃতিবিজরিত ওই হল-এর ভিতরে যে অত জায়গা রয়েছে, জানতাম না। রাখীদি, ঋতুদা– সবাই মিলে ভেতরে রেডি হচ্ছিল কার্টেন কল-এর জন্য। পুরো অভিজ্ঞতাটাই আমার কাছে এতটা নতুন! একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম ওই সন্ধেয়। শুধু বুঝতে পারছিলাম আশপাশের লোকেদের ব্যবহার একটু একটু বদলে যাচ্ছে। অযাচিত পাত্তা দিচ্ছে লোকে, অকারণে হেসে কথা বলছে। একটা সিনেমা এতটা বদলে দেয় জীবন? পর্দায় দেখলে এতটা সম্মান করে মানুষ?
প্রিমিয়ারের পরদিনের দুটো ফোনের কথা মনে আছে। অপরাজিতা আঢ্য ফোন করে বলেছিল, অভিনয় ভালো লাগার কথা। তখন অপার সঙ্গে একেবারেই আলাপ নেই। ওই ছবিতে রাজেশ শর্মার অবাঙালি স্ত্রীর ভূমিকায় ওর অভিনয়ও চিরকাল মনে রাখবে মানুষ। আর একটি ফোন তুমুল আশ্চর্যের– রমাদা, মানে রমাপ্রসাদ বণিক! নয়ের দশকে আমরা যারা কলেজ জীবন কাটিয়েছি, রমাদা আমাদের কাছে এক বিরাট আইকন। নাটক, পড়াশোনা, অভিনয়– এক অনন্য ব্যক্তিত্ব রমাদা। কারও থেকে আমার নাম্বার জোগাড় করে ফোন করেছিলেন। অনণুকরণীয় কণ্ঠস্বরে, ‘হ্যাঁ র্যা, তোর অভিনয় খুব ভাল লেগে গেল র্যা’, বলেছিলেন। ‘শুভ মহরৎ’ সৌজন্যে পাওয়া এই সার্টিফিকেট সত্যিই অমূল্য। রমাদাকে বলেছিলাম, ‘আমি নিয়মিত অভিনেতা নই, আর ভবিষ্যতে, ক্যামেরার সামনের চেয়ে পিছনের কাজেই বেশি আগ্রহী হব।’ আমার যারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, তারা অবশ্য শুভঙ্করকে নিয়ে খুব একটা উত্তেজিত হয়নি। আমি কী’রম করেছি, সেটাই সবাই দেখতে গিয়েছিল। এবং প্রায় সবাই হেসেছিল। কারণ আমি যেরকম শুভঙ্কর, তার তুলনায় আরও শান্ত, পরিশীলিত। বড্ড ঠার স্বরে কথা বলে। এত ভদ্রতা আর প্রেমে দাগা– বন্ধুরা মেনে নিতে পারেনি।
‘শুভ মহরৎ’ আমার কাছে এক নতুন দরজা। যারা চেনে তাদের কাছে আমার অচেনা হওয়ার, আর যারা অচেনা তাদের কাছে চেনা হওয়ার। সিনেমায় এ এক অদ্ভুত মজা। ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল টাইপ। হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসলাম যেন বাজারে। গান গাইছিলাম, লোকে চিনত, সে একরকম– কিন্তু ঋতুপর্ণর সিনেমায় অন্যতম নায়ক– এই তকমাটা জাঁকিয়ে বসল আনাচ-কানাচে। পত্র-পত্রিকায় ইন্টারভিউ, পার্টিতে আমন্ত্রণ– এক নতুন জীবন চালু করে দিল ওই এক ঋতুপর্ণই। আনন্দবাজারে ‘শুভ মহরৎ’-এর রিভিউ লিখেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। নবাগত অভিনেতার প্রশংসা করেছিলেন তিনি। গোটা রিভিউ-এ একটাই ছবি। সেখানে রাখী বা শর্মিলা ঠাকুর নয়, আমার আর নন্দিতার সিগারেট ধরানোর অপচেষ্টা। সবচেয়ে অসুবিধে হত আমার, পাড়ায়।
উত্তর কলকাতার বনেদি, সুপ্রাচীন গলি। বাড়ির মন্দিরে প্রচুর লোকের আনাগোনা। মাকে সকলেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল, শুভ মহরতের ছেলেটা আমিই কি না, বাবা প্রতিদিন বাজারে গিয়ে নিজেই চারশো লোককে জানাতে লাগল, আমার ছেলের সিনেমা বেরিয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশী-শুভানুধ্যায়ীদের প্রশ্ন– অনিন্দ্য কি এবার থেকে তাহলে ফিল্মের লাইনে চলে গেল পুরোপুরি? কোনও কোনও আত্মীয় ঠোঁট উল্টে বলল, আমার বাবা নন্দিতাকে ভালো লাগে না একদম!
……………………………………
উত্তর কলকাতার বনেদি, সুপ্রাচীন গলি। বাড়ির মন্দিরে প্রচুর লোকের আনাগোনা। মা-কে সকলেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল, শুভ মহরতের ছেলেটা আমিই কি না, বাবা প্রতিদিন বাজারে গিয়ে নিজেই চারশো লোককে জানাতে লাগল, আমার ছেলের সিনেমা বেরিয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশী-শুভানুধ্যায়ীদের প্রশ্ন– অনিন্দ্য কি এবার থেকে তাহলে ফিল্মের লাইনে চলে গেল পুরোপুরি? কোনও কোনও আত্মীয় ঠোঁট উল্টে বলল, আমার বাবা নন্দিতাকে ভালো লাগে না একদম!
……………………………………
‘ধুত্তোরি’ বলে আমি যে কোথাও কেটে পড়ব, তারও উপায় নেই। গানের দলবল ছাড়া, আর কোনও জায়গা রইল না লুকোনোর। অভিনয়ের ব্যাপারটার ওপর রেগে যখন কাঁই, সাতসকালে একদিন ঝুমুদির ফোন। মানে, সুদেষ্ণা রায়ের। টিভির জন্য একটা প্রোগ্রাম করছে, পুরনো কলকাতা নিয়ে, যতদূর মনে পড়ছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের রোল অফার করেছিল। সুদেষ্ণাদি আর রানাদা পরিচালক। দু’জনেই অসম্ভব চেনা। ‘সানন্দা’-য় ফ্রিল্যান্সিং-এর শুরুও সুদেষ্ণাদির হাতেই। ফলে ঝুমুদিকে ‘না’ করা বেশ মুশকিল। কিন্তু একটানা অভিনয় আমি করতে চাই না। ঋতুদাকে বললাম, ‘‘জানো তো, এর’ম একটা রোল করতে বলছে রানাদা-সুদেষ্ণাদি।’’ শুনে ঋতুদা কী’রম চুপ মেরে গেল। একটু পরে কেটে কেটে বলল, ‘তুই করিস না। যদি কিছু বলে, বলিস, আমি বারণ করেছি।’
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪২: ‘অসুখ’-এ গৌরী ঘোষের চরিত্রে গলা দিয়েছিল ঋতুদা নিজে
পর্ব ৪১: ঋতুদার ভেলকিতে খুনের থেকেও প্রেমের জখম বড় হয়ে দাঁড়াল
পর্ব ৪০: আমার ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিল সইফ আলি খান
পর্ব ৩৯: নন্দিতার জন্য নার্ভাস ছিলাম না, রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিলাম
পর্ব ৩৮: টোটার দেওয়া ডায়েট চার্ট পেয়ে নিজেকে হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল
পর্ব ৩৭: ফিরে এল কলেজবেলার কমপ্লেক্স– নন্দিতা দাস আমার চেয়ে লম্বা নয়তো?
পর্ব ৩৬: আমার ডিটেকটিভ একজন মহিলা, বলেছিল ঋতুদা
পর্ব ৩৫: চন্দ্রবিন্দুর কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে হবে না!
পর্ব ৩৪: বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, চ অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?