
সমরেশদা জেলে থাকাকালীন সময়ে গৌরী বউদি একদিন সটান বিধান রায়ের কাছে গিয়ে মাসোহারার দাবি করেছিলেন। ডা. রায় না কি বলেছিলেন⎯ ‘এখন মাসোহারা চাইতে এসেছ কেন? তোমার স্বামীকে গিয়ে বিপ্লব করতে বলো।’ তবে তিনি একটা মাসোহারার বন্দোবস্ত করেও দিয়েছিলেন। সমরেশদা জেল থেকে বেরনোর পর সেটা বন্ধ হয়। ফলে ‘উত্তরঙ্গ’ শেষ করাটা মুশকিল হয়। কেননা তাঁর সেসময় কোনও কাজই ছিল না। রোজগার একেবারে শূন্য।
৫৯.
দে’জ পাবলিশিং-এর শুরুর বছরে আমি ন’টা বই প্রকাশ করেছিলাম– একথা আগেও বলেছি। এখন হিসেব করে দেখলাম, তার ঠিক পরের বছর আমি মোট ২৬টি বই প্রকাশ করেছিলাম। দ্বিতীয় বছরে আশাপূর্ণা দেবী, আবু সয়ীদ আইয়ুব, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী, প্রফুল্ল রায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়⎯ নানা প্রজন্মের বিভিন্ন লেখকের বইয়ের পসরা নিয়ে আমাদের নতুন প্রকাশনা সেজে উঠেছিল। লক্ষ্য ছিল একটাই⎯ বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশ করা, যাতে পাঠক এসে দোকান থেকে ফিরে না যায়। আমি চিরকাল সে-চেষ্টাই করেছি। তবে ১৯৭২-এ দিনেশ দাশের ‘অসঙ্গতি’র আগে কবিতার বই যে প্রকাশ করতে পারিনি সেকথাও আগে বলেছি। যে-সময় আমি প্রকাশনার কাজ শুরু করলাম, তখন বাংলা গল্প-উপন্যাসের জগতে সমরেশ বসুর প্রতিষ্ঠা তুলানাতীত। সবাই তাঁকে ‘বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র’ বলত। চেহারায়, পোশাক-আশাকে⎯ তাঁকে দেখেই মনে হত একজন অসামান্য মানুষ চোখের সামনে হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছেন। তাঁর নতুন বই পাবার জন্য সেসময় যে-কোনও প্রকাশক মুখিয়ে থাকত। আমি শুরুতে ভেবেছিলাম আমার মতো নতুন প্রকাশককে তিনি হয়তো বই দেবেন না। কিন্তু পরে জানতে পারলাম বিশ্ববাণী প্রকাশনীর দৌলতে আমার বাবা এবং দাদাদের সঙ্গে সমরেশ বসুর বেশ হৃদ্যতা আছে। সেই পারিবারিক সম্পর্কের কারণেই আমি দ্বিতীয় বছরের একবারে শুরুতে দে’জ থেকে ছেপে ফেললাম সমরেশ বসুর নতুন উপন্যাস⎯ ‘রক্তিম বসন্ত’। অজিত গুপ্তর মলাটে আট টাকা দামের সে-বইটি ছেপেছিলাম ঈশ্বর মিল লেনের বাণীশ্রী প্রেস থেকে। এই বইটির কপি নেওয়ার জন্য সমরেশদার সার্কাস রেঞ্জের বাড়িতে আমার যাতায়াত শুরু হয়েছিল, যা বহুদিন নিয়মিতই চলেছে। ‘রক্তিম বসন্ত’ আমার মতো ১৯ বছরের ছেলের হাতে দিয়ে তাঁর মনে কি শঙ্কা ছিল না⎯ কেমন ছাপবে, আদৌ বইটা ঠিকমতো করতে পারবে কি না! কিন্তু ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে বই প্রকাশের পর যখন তাঁর বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে এলাম⎯ সমরেশদার প্রসন্ন মুখ দেখে বুঝেছিলাম খুব খারাপ কাজ করিনি। অন্তত পরের বইটা চাইতে যাওয়ার রাস্তা খোলা রইল!

দে’জ থেকে সমরেশদার পরের বই বেরল ঠিক এক বছরের মাথায়। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে আমি প্রকাশ করলাম তাঁর আরও একটি নতুন লেখা⎯ ‘নিঠুর দরদী’। রবীন দত্তর মলাটে বইটা ছাপা হয়েছিল ঈশ্বর মিল লেনেরই অন্য একটি ছাপাখানা⎯ পরাণচন্দ্র রায়ের সনেট প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে। নিশ্চয়ই তখন বাণীশ্রীতে কাজের চাপ বেশি ছিল, তাই হয়তো পাশের ছাপাখানায় যেতে হয়েছিল। ‘নিঠুর দরদী’র শুরুতে লেখক ‘একটি কথা’ নামে পাঠকের কাছে কৈফিয়তের মতো কিছু কথা লিখেছিলেন⎯
“…‘নিঠুর দরদী’ পাঠকদের কাছে, পুস্তকাকারে ঠিক এভাবে উপস্থিত করার ইচ্ছা ছিল না। উপন্যাসটি পত্রিকায় প্রকাশের পরে, অনেক পাঠক-পাঠিকার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। উপন্যাসটি পাঠকদের ভাল লাগা ছাড়াও, কিছু সংশয়ান্বিত প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে, এ উপন্যাসের, বিশেষ চরিত্র শ্যামলকে কেন্দ্র করে। শ্যামল এই উপন্যাসের সমগ্র ঘটনার যেমন সাক্ষী, তেমনি নিজেও জড়িত। তার এই জড়িয়ে থাকাটা নিয়েই নানান জিজ্ঞাসা। সে কি মল্লিকাকে ভালবাসে? যদি বাসে, তবে তার ভালবাসার সেই দাবী কোথায়?
মল্লিকা কি অভিজিৎকে ভালবাসে? সে ভালবাসার স্বরূপ কী।
এসব প্রশ্নের জবাবের জন্য হয়তো উপন্যাসে আরো কিছু সংযোজন করা যেতো। কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত, তাতে সরল ব্যাখ্যা কিছুই মিলতো না। কেন না, জীবন সরল নয়। আমরা যাকে বাস্তব বলি, জীবন তার চেয়ে অনেক বেশি অপ্রাকৃত, হিসাবে মেলে না। সেই হিসাবে পাঠকের চিন্তা আর কল্পনা এবং সিদ্ধান্তের ওপরেই ভরসা করে রইলাম।”
এই ভূমিকাটা পড়তে-পড়তে পুরনো দিনে লেখক-পাঠকের নিবিড় সম্পর্কের কথা মনে পড়ল। বিশেষ করে সমরেশদার মতো জনপ্রিয়, গুণী সাহিত্যিকদের কোনও লেখা কোথাও প্রকাশিত হলে সেই পত্রিকায় এবং সরাসরি লেখকের ঠিকানাতেও পাঠকের চিঠি উপচে পড়ত। সেসব চিঠি কেবল গুণমুগ্ধ পাঠকের স্তুতিতেই ভরা থাকত না, লেখার গঠনমূলক সমালোচনাও থাকত কখনও-কখনও। যেমন এই কৈফিয়তটা পড়েই বোঝা যায়, লেখক কতটা ভেবেছেন পাঠকের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আমরা তো চিঠি লেখার অভ্যেসটাই হারিয়ে ফেলেছি⎯ তাহলে আর পাঠকের চিঠির প্রত্যাশাই-বা করি কীভাবে! পত্রপত্রিকায় দু’ দশক আগেও অসামান্য সব চিঠি প্রকাশিত হত। এখন তেমন তাক-লাগানো চিঠি খুব একটা দেখি না। তবে আমি আশাবাদী মানুষ⎯ নিশ্চয় ই-মেল অথবা সমাজমাধ্যমে লেখক-পাঠক যোগাযোগটা এখনও আছে।
১৯৭২ সালে দে’জ থেকে সমরেশদার কেবল ‘নিঠুর দরদী’ই নয়, আরও চারটে বই প্রকাশিত হয়েছিল। একবছরে মোট পাঁচটা।

সুরথনাথ বসুর লেখক সমরেশ বসু হয়ে ওঠাটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ হলেও প্রথম লেখা উপন্যাস কিন্তু ‘নয়নপুরের মাটি’। অবশ্য তারও আগে ১৯৪৬-এর ‘পরিচয়’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় ছাপা হয়ে গেছে তাঁর সাড়া জাগানো গল্প ‘আদাব’। সমরেশ বসুর জীবনে জগদ্দলের কমিউনিস্ট নেতা সত্যভূষণ দাশগুপ্তের (লোকমুখে ‘সত্যমাস্টার’) ভূমিকা অনেক বড়। তিনিই সমরেশদাকে প্রথম ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকা পড়ান এবং ধীরে-ধীরে তাঁকে কমিউনিস্ট পার্টির পরিধির মধ্যে টেনে নেন। ততদিনে সমরেশ বসুর সঙ্গে গৌরী দেবীর বিয়ে হয়ে গেছে। তাঁরা উঠে এসেছেন আতপুরের একটি বস্তির ঘরে। সত্যমাস্টারের কথাতেই কিছুদিন পরে তাঁরা সেই বস্তির বাসা ছেড়ে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়ায় উঠে আসেন। অবশ্য সেখানেও জীবনযাপন খুব সুখের ছিল না। তবে সত্যমাস্টারের চেষ্টাতেই ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে তিনি একটা কাজ পান⎯ ইছাপুর গান ফ্যাক্টরির ড্রয়িং অফিসে এক টাকা চার আনা রোজে ট্রেসারের কাজ। পরিস্থিতি এমন ছিল যে সেই কাজটাই সমরেশদার জীবনে সেসময় আশীর্বাদের মতো এসেছিল। এইরকম দিনযাপনের মধ্যেই ‘আদাব’ লেখা ও ছাপা হয়ে গেছে। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় যে সে-গল্প ছাপা হবে এমন আত্মবিশ্বাস তখন সমরেশ বসুর ছিল না। তিনি তখন রোজ শ্যামনগর থেকে এক মাইল দূরে ইছাপুরে গিয়ে চাকরি করতেন। একদিন সকালে অফিস যাওয়ার আগে ভাত খেতে বেসেছেন, এমন সময় তাঁর বন্ধু গৌর এসে জানান, কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় শারদ সংখ্যা ‘পরিচয়’-এর বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে এবার গল্প ছাপা হবে⎯ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, পরিমল গোস্বামী এবং সমরেশ বসুর। প্রথম গল্পেই এমন বিরাট পরিচিতি কিন্তু খুব কম লেখকের জীবনেই ঘটে।
কিন্তু জীবন মানুষকে শেখায় অনেক কিছু। ‘আদাব’ প্রকাশের পর উৎসাহিত হয়ে তিনি দ্রুত আরেকটি গল্প পাঠিয়েছিলেন ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। কিন্তু এবারে লেখাটা ফেরত দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে একটি চিঠিতে লেখেন⎯ ‘আপনার দ্বিতীয় গল্পটি, যেহেতু প্রথম গল্পের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে না, সেই হেতু গল্পটি ফেরত পাঠালাম। নতুন একটি গল্প অবিলম্বে পাঠান…’। আমার মনে হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু সমরেশ বসুর লিখনশৈলীর জন্য কিংবা বাংলার প্রগতিশীল সাহিত্যধারায় নতুন লেখক পাওয়ার আশাতেই নয়, ১৯৪৬-এর ১৬ থেকে ১৮ আগস্ট কলকাতায় যে-ভয়াবহ দাঙ্গা চলে তার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবেও ‘আদাব’ গল্পের মূল্য বুঝেছিলেন। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দে’জ থেকে প্রকাশিত যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: ডায়েরি ও চিঠিপত্র’ বইটিতে দেখছি ১৯৪৬-এর ১৬ থেকে ১৮ আগস্ট মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দাঙ্গার দিনগুলিতে অসহায়তার কথা লিখছেন। ১৭ আগস্ট তো তাঁকে দেড়শো লোকে মিলে ঘিরে ধরে প্রায় মারতে উদ্যত হয়েছিল। ১৮ আগস্ট, রবিবার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়েরিতে লিখছেন⎯
“মিটমাটের চেষ্টা ব্যর্থ হবে, কাল বিকালের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছি। খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা সেই কালো লোকটির লম্বা বক্তৃতা দিয়ে আমার বোঝাবার চেষ্টা⎯ তার পেছনে ভিড়ের সায়। পাকিস্তানের দাবী বাতিল করা হচ্ছে⎯ ব্যাটারা টের পাচ্ছে! যেখানে মুসলমানেরা দলে ভারি সেখানে যে হিন্দুরাও টের পাচ্ছে⎯ আমার এ যুক্তি উড়ে গেল। মুসলমানরা এদের এ পাড়ায় এসে নাকে খত দিলে মিটমাটের কথা চলতে পারে। ক’জনকে বক্তৃতা করতে দেওয়ায় মারটা খেলাম না। K. P. Roy Lane দিয়ে বাঁক পৰ্য্যন্ত এসেছি⎯ লাঠি হাতে এক ছোকরা পথ আটকে ছিল⎯ ফের আমায় ভিড় ঘিরে ধরল। এক ছোকরা লাঠি দিয়ে মারে আর কি!⎯ নিজেই ধমক দিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করলাম। ধীর শান্ত আত্মপ্রতিষ্ঠ ভাব না বজায় রাখতে পারলে নিশ্চর মার খেতাম। ‘শালা কম্যুনিষ্ট!’ ‘মুসলমানের দালাল।’ রব উঠছিল চারি দিকে।
আজ বিকালে আবার ফাঁড়ির সামনে দিয়ে পুলের তলা হয়ে K. P. Lane দিয়ে ঘুরে এলাম। ফাঁড়ির মোড়টা জনহীন⎯ দূরে চারু মার্কেটের দিকে রাস্তায় হাঙ্গামা হচ্ছে। পাশে একটা বাড়ীতে আগুন লেগেছে। K. P. Lane-এ বহু লোক-উত্তেজিত, হিংস্র। ছাদ থেকে এক বেটা চীৎকার করল⎯ ‘ওই সেই ব্যাটা ঔপন্যাসিক যায়!’ ধীরপদে চলতে লাগল [লাগলাম]। একজন পাশে চলতে চলতে লজ্জিতভাবে বলল⎯ ‘দেখে যা ভাবছেন তা নয় কিন্তু সবাই উত্তেজিত কিন্তু aggressive নয়।’
বৃটিশ সিংহ বুঝি মুচকে হাসছে?…”

কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমরেশদার দ্বিতীয় গল্পটি প্রত্যাখ্যান করায় লেখক সমরেশ বসু একটা বড় শিক্ষাও পেয়েছিলেন। সমরেশদা এই প্রসঙ্গে ‘নিজেকে জানার জন্যে’ নামক গদ্যে লিখেছেন⎯ “…সে-ই আমার কপালে প্রথম ‘অ’-এর টিকা, এখন মনে হয় অসামান্য সেই টিকা। সেই অমনোনয়ন সংযত করেছিল নতুন লেখনের অতি-উদ্দীপনাকে, সজাগ করেছিল দৃষ্টি ও চিন্তাকে, জিজ্ঞাসু করেছিল ভাবনাকে, দূরবগাহী কিন্তু বিসর্পিল যার গতি; আর এই ভাব ঐশ্বর্যের মহিমার পিছনে আমি এখনো ছুটে চলেছি, কারণ এই একটি অমনোনয়নই চিহ্নিত করে দিয়েছে, আমার সারা জীবনের অমনোনয়নের, যুগপৎ বিষাদ ও উদ্দীপনাকে। অমনোনয়ন এখন আমার নিজের ভিতর থেকেই উৎসারিত, আদ্যন্ত আমার রচনা ও ব্যক্তি মানসিকতার দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। এই নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্যে আমি বাঁচি। পথের ঐকান্তিক মোক্ষ, অতএব কোথায়? সন্ধান মেলেনি অদ্যাপি।”
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নয়নপুরের মাটি’ লেখার বৃত্তান্তও তিনি শুনিয়েছেন সেই রচনাটিতে⎯
“…‘নয়নপুরের মাটি’ লিখেছিলাম ইছাপুরের রাইফেল ফ্যাকটরির ইনস্পেকটরেট অব স্মল আর্মস-এর নকশাঘরে বসে অবকাশের সময়ে এবং অবিশ্যি বাড়িতেও। কিন্তু বাড়ি ফিরে সময় থাকতো কম। কারণ, ভোররাত্রের অন্ধকার থাকতে রাস্তার মিউনিসিপ্যালিটির জলকলে স্নান করে নাকে মুখে কিছু গুঁজে ছুটতাম শ্যামনগর স্টেশনে, সেখান থেকে ট্রেনে ইছাপুর। দৈনিক বেতন এক টাকা চার আনা। তার সঙ্গে ছিল ওভারটাইমের অবদান, যার প্রতিটি পয়সাই ছিল এক একটি অন্নের দানার মতো মূল্যবান। শুনেছি, তেজারতির কারবারীদের কাছে, আসলের থেকে সুদের দাম বেশি। আমার কাছে ওভারটাইমের মূল্য ছিল সেইরকম। অতএব, বাড়ি থেকে বেরোতাম অন্ধকার থাকতে, যখন বাড়ি ফিরে আসতাম, তখন আমার কুটিরে জ্বলতো কেরোসিনের আলো। কাজে যাবার সময় ঘুমিয়ে থাকতো আমার সন্তানেরা, ফিরে যখন আসতাম, তখন তারা রাত্রের ঘুমে শায়িত। একজনকেই থাকতে হতো জেগে, সেই ভোর রাত্রি থেকে, রান্নাবান্না সংসারের সকল কর্ম আর সন্তান সন্ততিদের এবং আমার সেবার জন্যও বটে, বলা বাহুল্য তিনি আমার স্ত্রী। প্রায় চৌদ্দ ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরে, ক্লান্ত শরীরে লিখতে বসাটা প্রায় অসম্ভব মনে হলেও ভিতরের উন্মাদনা কোনো ক্লান্তিকেই মেনে নিতো না। আবার লিখতে বসতাম হ্যারিকেনের আলো নিয়ে কিন্তু অভাব ছিল কেরোসিন তেলের। সময়টা যুদ্ধের কাল, জীবনধারণের সবকিছুই ছিল প্রায় নাগালের বাইরে, নিতান্ত কোনোরকমে বেঁচে থাকা ছাড়া।”

কিন্তু জীবন আবার কবে ধরাবাঁধা পথে চলে। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগ থাকার অপরাধে তাঁর জেল হয়। যদিও জেলে গিয়ে তিনি দলীয় রাজনীতির ভেতরে পাঁকের গন্ধটা প্রথম অনুভব করেন। তবু সেখানে তিনি অনেকটা সময় লেখালিখিতেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। জেলে বসেই লেখা হয় ‘লেবার অফিসার’ নাটক এবং ‘উত্তরঙ্গ’ উপন্যাসের কিছু-কিছু অংশ। তখন জেলখানায় তাঁর সহবন্দি ছিলেন গণনাট্য সংঘের সম্পাদক নিরঞ্জন সেন। নিরঞ্জনবাবু তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন বাইরে গিয়ে বই প্রকাশের ইচ্ছে থাকলে তাঁর ভাই⎯ বুক ওয়ার্ল্ড পাবলিশার্সের কর্ণধার শচী সেনের সঙ্গে দেখা করতে।
সমরেশদা জেল থেকে বেরিয়ে শচীবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘নয়নপুরের মাটি’র কথা বললেও সে উপন্যাসের বিষয়বস্তু তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি আগ্রহী হন ‘উত্তরঙ্গ’ উপন্যাসে। এদিকে সে-উপন্যাস লিখতে তো সময় লাগবে। ততদিন চলবে কী করে। সমরেশদা জেলে থাকাকালীন সময়ে গৌরী বউদি একদিন সটান বিধান রায়ের কাছে গিয়ে মাসোহারার দাবি করেছিলেন। ডা. রায় না কি বলেছিলেন⎯ ‘এখন মাসোহারা চাইতে এসেছ কেন? তোমার স্বামীকে গিয়ে বিপ্লব করতে বলো।’ তবে তিনি একটা মাসোহারার বন্দোবস্ত করেও দিয়েছিলেন। সমরেশদা জেল থেকে বেরনোর পর সেটা বন্ধ হয়। ফলে ‘উত্তরঙ্গ’ শেষ করাটা মুশকিল হয়। কেননা তাঁর সেসময় কোনও কাজই ছিল না। রোজগার একেবারে শূন্য। তখন শচীবাবুই তিন মাসে খেপে-খেপে ১৫০ টাকা দেন তাঁকে। কিন্তু তাঁরও আর্থিক সীমাবদ্ধতা ছিল। বই যখন দপ্তরিখানায় তখন সমরেশদা টাকা চাইলেও তিনি দিতে পারেননি। এদিকে কার্যত সেসময় সমরেশদা কয়েকদিন অভুক্ত বললেই ঠিক হয়। বাড়ির অবস্থাও তথৈবচ। তাই শচী সেন দপ্তরির ঘর থেকে কিছু বই নিয়ে গিয়ে সমরেশদাকে বিক্রি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সমরেশদা তাই শুনে নৈহাটি গিয়ে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ চৌধুরী, প্রভাত বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশ দে প্রমুখ অনুজ-বন্ধুদের খবর দিলেন যে পরের দিন তিনি নৈহাটির ‘বাসন্তী কেবিন’-এ (পরে এই বাসন্তী কেবিন নিয়েই লেখা হবে ‘শ্রীমতী কাফে’) বই নিয়ে আসবেন। বন্ধুরা যেন হাজির থাকেন। সমরেশদা সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন⎯
“কলকাতায় গিয়ে, বই যখন আনতে গেলাম, তখন আকাশ জুড়ে কালো মেঘ, বিদ্যুৎ হানাহানি। মানিকতলায় রেললাইনের ধারে এক বাস্তুহারা দপ্তরীর ঘরে বই। পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই মুষলধারে বৃষ্টি। দপ্তরীর কাঁচা ঘরে, বেড়ার ফাঁক দিয়ে হুহু করে জল ঢুকছে। দপ্তরী সপরিবারে তাদের সমস্ত বই কাগজ একটা পাটাতনের ওপর তুলতে লাগলো। দপ্তরী হেসে বললো, ‘আর কইয়েন না, বিষ্টি নামলেই ঘর ভাইস্যা যায়।’
মিথ্যা না, আমি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই জল আমার পায়ের পাতা ছাপিয়ে উঠলো। বৃষ্টি যখন একটু কমলো তখন জল আমার হাঁটুর কাছে। অথচ আর দেরি করতে পারি না। অন্ধকার ঘরে, কপর্দকহীন আমার স্ত্রী অপেক্ষা করছেন, নৈহাটিতে আমার ক্রেতা বন্ধুরাও যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেলে আমাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি হবে। বৃষ্টিতে বই ভিজে যাওয়ার দুশ্চিন্তা। দপ্তরীই বুদ্ধি দিল। ‘গায়ের জামাটা খুইল্যা ঢাইকা লইয়া যান।’
তা ছাড়া উপায় ছিল না। গায়ের জামা খুলে বই জড়িয়ে হাঁটু জল ভেঙে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখনো বেশ বৃষ্টি। বইটার মলাটের ওপরে আমার এখনো গভীর মমতা আছে। এঁকেছিলেন ও সি গাঙ্গুলি (জুনিয়র)। বাঁচাবার অনেক চেষ্টা করেও ভেজার হাত থেকে পুরোপুরি বাঁচাতে পারিনি। নৈহাটি বাসন্তী কেবিনে গিয়ে দেখলাম, বন্ধুবর সরোজ ছাড়া আর সবাই আছে। ও বরাবরই সন্ধেরাত্রে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার লোক। নতুন বইয়ের গন্ধ, বন্ধুদের উষ্ণ অভ্যর্থনা গরম চা এক কাপ, এক কথায় মৃত সঞ্জীবনী সুধা। যতোদূর মনে পড়ে তিরিশ টাকারও কিছু বেশি নিয়ে, আমার আতপুরের কুটিরে ফিরে গিয়েছিলাম। বইটার দাম ছিল সাড়ে তিন টাকা। বন্ধুরা কেউ কমিশনের কথা ভাবেইনি। সেই রাত্রিটি বড় সুখের। হাসিতে, চোখের জলে এক অনির্বচনীয় আনন্দে প্রাণটি ভরা, আমার লেখা প্রথম ছাপা বই আমার বুকে। কী তৃপ্তিদায়ক তার উষ্ণতা।…”

কিন্তু ‘উত্তরঙ্গ’ উপন্যাসকে আক্রমণ করে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় সমালোচনা করলেন চিন্মোহন সেহানবীশ। অভিযোগ ছিল অশ্লীলতারও। অবশ্য ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় সনৎ বসু চিন্মোহন সেহানবীশের সমালোচনার প্রতিবাদ করেন। ফের ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় সমালোচনা করেন অচ্যুত গোস্বামী। তার পালটা লেখেন গান্ধী ও বার্নার্ড শ-এর জীবনীকার ঋষি দাশ। এই ঋষি দাশের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানির প্রহ্লাদ প্রামাণিকের। ‘মরসুমের একদিন’ নামে একটি গল্পের বইয়ের জন্য প্রহ্লাদবাবু পুরো ১১০০ কপির রয়্যালটি অগ্রিম দেওয়ায় সমরেশদা কিছুদিনের জন্য নিশ্চিন্ত মনে লেখালিখি করতে পারেন। এদিকে ‘উত্তরঙ্গ’ পড়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন সিগনেটের ডি কে। তিনি বলেছিলেন, এই উপন্যাসের লেখককে সোনার কলম দেওয়া উচিত। এবং সত্যি-সত্যি তিনি সমরেশ বসুকে একদিন বাড়িতে ডেকে একটি দামি কলম আর ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ বইটির দু’টি খণ্ড উপহার দেন। সমরেশদার জীবনের প্রথম পুরস্কার⎯ একটা ফাউন্টেন পেন পাওয়া তখন তাঁর কাছে প্রায় স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতোই ছিল। এরপর লেখক সমরেশ ক্রমশ এগিয়ে গেছেন। কিন্তু জীবনে জটিলতাও বেড়েছে, পার্টির সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে⎯ কুৎসা এবং প্রশংসা দুই-ই পেয়েছেন জীবনে। তবে একদিন শান্তিনিকেতনে অন্নদাশংকর রায়ের বাড়িতে চায়ের আসরে লীলা রায় তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করেন– তাঁর লেখার মূল উদ্দেশ্য কী? সমরেশদা না কি উত্তরে বলেছিলেন, তিনি জানবার জন্য লেখেন। লীলা রায় ফের প্রশ্ন করেন⎯ তিনি কী জানতে চান? সমরেশদা বলেছিলেন⎯ মানুষকে জানতে চান তিনি। তার উত্তরে লীলা রায় না কি বলেন⎯ ‘নিজেকে জানবার জন্য নয় কেন?’ এই কথাটা তাঁর বুকে গেঁথে গিয়েছিল। আজীবন তিনি নিজেকে জানার জন্যেই লিখে গেছেন।

১৯৭২ সালে ‘নিঠুর দরদী’ ছাড়াও ‘কামনা বাসনা’, ‘ছায়া ঢাকা মন’ নামে দুটি উপন্যাস আমি ছেপেছিলাম। সেইসঙ্গে ছেপেছিলাম কালকূট নামে লেখা ‘আরব সাগরের জল লোনা’ আর ‘নির্জন সৈকতে’। এই দু’টি বইয়ের মধ্যে ‘নির্জন সৈকতে’ আমি পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম। এই বইটি উপন্যাস হিসেবে যেমন নাম করেছিল তেমনই ১৯৬৩ সালে এই উপন্যাস নিয়ে তপন সিংহের ছবিটিও বিখ্যাত হয়েছিল। সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ছায়া দেবী, রেণুকা রায়, ভারতী দেবী, শর্মিলা ঠাকুর, রুমা গুহঠাকুরতা, অনিল চট্টোপাধ্যায়, পাহাড়ী সান্যাল, রবি ঘোষ প্রমুখ। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য ছায়া দেবী, রেণুকা রায়, ভারতী দেবী, শর্মিলা ঠাকুর ও রুমা গুহঠাকুরতা সেবছর ভারতের তৃতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যৌথভাবে ‘রৌপ্য ময়ূর’ পুরস্কার পান। এই বইটি ১৯৬২ সালে ত্রিবেণী প্রকাশন থেকে প্রথমবার বেরিয়েছিল। দে’জ সংস্করণের জন্য একটি ছোট্ট মুখবন্ধে সমরেশ বসু ওরফে কালকূট লেখেন⎯ “একটি ছোট সংবাদ পাঠককে দেবার জন্যেই এই ভূমিকার প্রয়োজন হল। ‘নির্জন সৈকতে’ ভ্রমণ কাহিনীটি ১৩৬৮ সালের শারদীয় জলসা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। অধিকাংশ শারদীয় লেখারই যা অবস্থা, অর্থাৎ স্থানের সীমাবদ্ধতা এবং সম্পাদকের তাড়ায় কোনোরকমে সংক্ষেপে লেখা শেষ করা, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্বভাবতই গোটা বইটি এই আকারে প্রকাশের পূর্বে, সম্পূর্ণ নতুন করেই আবার লেখা হয়েছে। বলা বাহুল্য, বহু নতুন চরিত্র ও ঘটনাও সন্নিবেশিত হয়েছে। কলেবর বৃদ্ধির কারণও এই। আর একটি নিবেদন, পত্রিকায় যেভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, চিত্র পরিচালক তপন সিংহ মহাশয় তার ওপরেই ছবি তৈরি করেছেন, অতএব নির্জন সৈকতের দর্শকেরাও অনেক নতুনের সন্ধান থেকে বঞ্চিত হবেন না।”

এক সাক্ষাৎকারে ড. নিতাই বসুকে তিনি বলেছিলেন ‘কালকূট’ ছদ্মনাম নেওয়ার কারণটা। তাঁর কথায়⎯ ‘ছদ্মনাম নিলাম এই কারণে যে তখন আমি যে ধরনের লেখা লিখতাম, এই লেখা, তার থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র। আমি মেলায় যা দেখে এসেছি, ব্যাপারটাকে ওইভাবেই রাখতে চাই, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব তথ্য তুলে ধরতে চাই। তাই আমি ভাবলাম যে আমি ছদ্মনামের আড়ালে থাকব। এখানে আমি তো কল্পনার কোন আশ্রয় নিচ্ছিনা, সত্যি সত্যি যা দেখে এসেছি, তাই লিখব। তাই সমরেশ বসু নাম না নিয়ে অন্য নাম নিলেই সেটা ঠিক হবে। যাতে আমাকে কেউ আইডেন্টিফাই করতে না পারে। তবে, তার আগেই ফিফটি টু-তে কালকূট ছদ্মনাম নিয়ে আমি একটা পলিটিক্যাল রিপোর্টাজ লিখেছিলাম।’ ওই পলিটিক্যাল রিপোর্টাজটি সম্ভবত ‘ভোটদর্পণ’ নামে কালকূটের রচনাটি। তবে মেলার কথা যখন উঠল, তখন ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ লেখার কথা কিছুটা বলতেই হয়।
১৯৫৪ সালে প্রয়াগে কুম্ভমেলার ঘোষণা শোনার পর থেকেই তাঁর মনে হচ্ছিল এই মেলায় যেতে হবে। তাঁর ভাষায়⎯ ‘সারাদেশের মূর্তিখানি যদি দেখতে হয়, তবে সেই মেলার প্রাঙ্গণে চলো’। কিন্তু আর্থিক অনটনে সেখানে যাওয়ার কথা তাঁর চিন্তা করাও কঠিন ছিল। একদিন বেঙ্গল পাবলিশার্সের মনোজ বসুকে গোটা বিষয়টা জানালে তিনি একটি চিঠি দিয়ে সমরেশদাকে পরিমল গোস্বামীর সঙ্গে ‘যুগান্তর’ দপ্তরে দেখা করতে বলেন। কিন্তু পরিমল গোস্বামী সেদিনের তাঁকে যে-ভঙ্গিতে প্রত্যাখ্যান করেন তা মানতে কষ্ট হয়েছিল সমরেশদার। শেষমেশ ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরদাকে (সাগরময় ঘোষ) সবটা জানাবেন বলে সেখানে যান। আনন্দবাজার তখন বর্মণ স্ট্রিটে। সমরেশদা ‘গাহে অচিন পাখি’ গদ্যে আনন্দবাজার দপ্তরের ঘটনা প্রসঙ্গে লিখছেন⎯
“…তবু জয় মা বলে যাই তো। চলে গেলাম তার পরের দিন। এবার আর কোনও চিঠি চাপাটি সঙ্গে নেই। চলো ঝাড়া হাত পা, চলো, তারপর দেখা যাবে, মরার বাড়া নাকি গাল নেই। তবু ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে ঢোকবার আগে ‘বড় আশা করে এসেছি গো’ জপতে জপতে ঢুকলাম। দেখলাম সাগরবাবুর মুখোমুখি আর একজন বসে আছেন। খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবি পরা, মাথার চুল ছোট করে কাটা, শক্ত স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি। সাগরবাবুকে নমস্কার করে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, সেই ভদ্রলোক একবার আমার দিকে তাকালেন। মিথ্যে বলব না, একটু পিলে চমকে উঠল। রাশভারি চেহারা, গম্ভীর মুখ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আপাতত একটি অনীহা। সাগরবাবু আমাকে বসতে বললেন। বসলাম। তারপর?
তারপর সেই অকম্পিত-রেখা মুখ এবং নির্বিকার পাশের চেয়ারের ভদ্রলোক, কেউ কোনো কথা বলেন না। আমার তো জান ছটকে যাবার অবস্থা। সময় বহিয়া যায়। কিন্তু যেতে দিলে চলবে না। পাশের ভদ্রলোকের সামনেই, আমতা আমতা করে মুখ খুলতে হল, সাগরবাবুর কাছে।
সাগরবাবু বৃত্তান্ত সব শুনলেন আর শুনতে শুনতে তিনি বারেবারেই তাকাচ্ছিলেন সামনের ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক ঘাড় কাত করে, ভ্রুকুটি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন, আর মাঝে মাঝে সাগরবাবুর দিকেও দেখছিলেন। আমার প্রস্তাব শেষ হতেই, সাগরবাবু সামনের ভদ্রলোককে সম্বোধন করে বললেন, ‘কানাইদা, ইনি হচ্ছেন⎯’
যিনি কানাইদা তিনি হঠাৎ মুখ খুললেন। আহ্, গর্জিত স্বরেও কী মধুর বাণী বাজে! বলে উঠলেন, ‘গুড! ভেরি গুড আইডিয়া! কী বল সাগর?’
সাগরবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার তো খুব ভালই লাগছে।’ বলে আমাকে বললেন, ‘ইনি কানাইলাল সরকার।’
নামটা শুনলাম, তাঁর মহিমা তখনও কিছুই জানি না। আমি হাত তুলে নমস্কার করলাম। কানাইবাবু মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আপনি চলে যান এলাহাবাদ, আমরা আপনার লেখা ছাপব। দেশে নয়। আনন্দবাজারে। আপনি কুম্ভমেলায় যেতে চান, দেখতে চান, শুনে খুব ভালো লাগল। আমি খুশি হয়েছি। আপনি যান, দেখুন আর আমাদের সংবাদ দিন। ফটো তুলতে পারেন?’
আমার অবস্থা তখন কাকেই বা কী বোঝাব! খুশিতে প্রাণ ডগমগ হতে হতেই ঝপ্। তবু বলে ফেললাম, ‘পারি। বক্স ক্যামেরায়।’
কানাইবাবুর মুখে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটু হাসি দেখা গেল। সাগরবাবুর দিকে একবার তাকালেন। সাগরবাবুর টেপা ঠোঁটেও কি হাসির ঝিলিক? কানাইবাবু বলে উঠলেন, ‘ওতেই হবে। আমরা নেগেটিভ দেখে শুনে প্রিন্ট করে বড় করে নেব। আপনি⎯ হ্যাঁ আপনি ওখানে গিয়ে একটা কাজ করবেন। আপনি নিশ্চয়ই রোজ মেলায় মেলায় ঘুরবেন?’
আমি ঘাড় কাত করে বললাম, ‘হ্যাঁ, তাই তো যাচ্ছি।’
‘বেশ, ভেরিগুড।’ কানাইবাবু নড়েচড়ে বসে বললেন, ‘আপনি যা দেখবেন-আই মীন, বিশেষ বিশেষ সব ঘটনা, রোজ একটা ইনল্যান্ড খামে লিখে পাঠাবেন। আমরা সেগুলো সংবাদ করে ছাপব। আমরা আপনার প্রত্যেকটি চিঠির জন্য⎯ ইয়ে (এক মুহূর্ত মুখ বুজে ভাবলেন, ভ্রূকুটি চোখের তারা এক কোণে বিদ্ধ হল, তারপরেই) হ্যাঁ, কুড়ি টাকা করে দেব। টুয়েনটি রুপিজ, অ্যাঁ কী বলো সাগর?’
সাগরবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, ভালই তো।’
কানাইবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি ফিরে এসে আর্টিকেল টার্টিকেল গোছের যা লিখতে চান, লিখবেন আনন্দবাজারের লাস্ট পেজে ছাপা হবে।’
আমি তো যেন বাসর ঘরের বউ। যেমন আনন্দ, তেমনি ভয়। গলার স্বরই যে গর্জানো! বললাম, ‘আচ্ছা।’…”

গোটা ঘটনাটা ঘটার পর কানাইলাল সরকার যখন উঠে যান, তখন সমরেশদা জানতে পারেন কানাইলাল সরকারই হলেন সেসময়ের আনন্দবাজারের অন্যতম প্রধান কর্ণধার। এইভাবে বাংলা সাহিত্যের বড় আসরে কালকূটের পদার্পণ। কারণ কুম্ভমেলা থেকে ফিরেই সমরেশ বসু লিখতে শুরু করেন বাংলা সাহিত্যের এক চিরায়ত সম্পদ⎯ ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’।
কালকূটের ‘আরব সাগরের জল লোনা’ আমিই প্রথম প্রকাশ করেছিলাম। পূর্ণেন্দুদা নানারকম রং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে দু’-তিন বার প্রচ্ছদ এঁকে শেষমেশ এই বইয়ের প্রচ্ছদ স্থির করেন। বইয়ের জন্য কিছু অলংকরণও তিনি করে দিয়েছিলেন। বইটির ভূমিকায় লেখক লেখেন⎯
‘পূর্ণতার স্বাদ। তা কি জীবনে কখনো মেলে ? আমার জীবনে তো মেলেনি। মনে করি, নিরন্তর এই মানব জীবনের স্রোতধারায় কখনো তা মেলে না। তাই মানুষ চলেছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে, তার বহুতন্ত্র আশা আকাঙ্ক্ষা প্রার্থনা নিয়ে। কথাগুলো মনে এল এই রচনাটির কথা ভেবে। লিখে যা শেষ করতে পারলাম না, পূর্ণতার থেকে অপূর্ণতাই যেন বেশি রয়ে গেল। আরব সাগরের কূল থেকে নিয়ে আসা আমার বক্ষপুটে আশ্রিত আরো কতো মুখ, কতো মানুষ, কতো বিচিত্র তাদের জীবন, বিচিত্রতর ঘটনা, বিচিত্রতম বিস্ময়।
সব কথা বলা হল না। বাঁধা বুলির মতন সেই কথাটিই বলি, পরবর্তী সংস্করণে আরো সংযোজনের ইচ্ছা রইল। তখনো কি বলতে পারবো, পূর্ণতাকে পেলাম। বোধহয় না। তাই বলি, এই রচনার বর্তমান রূপে অপূর্ণতার মধ্যেও পূর্ণতার একটি ছায়া টানতে চেয়েছি।’

পূর্ণতার সন্ধানী সমরেশদা বইটির উৎসর্গের পাতায় লিখেছিলেন⎯ ‘ঋত্বিক ঘটককে/ বন্ধুবরেষু’। অবশ্য তখনও ঋত্বিকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ মুক্তি পেতে কয়েক বছর বাকি। সে-ছবিতে ঋত্বিক (সিনেমায় ‘নীলকণ্ঠ’) তাঁর এক পুরনো বন্ধু, এককালের সংগ্রামী ও সমাজসচেতন লেখকের অধঃপাতে যাওয়ার নমুনা হিসেবে যেসব লেখার নাম বলেন সেগুলো হল⎯ ‘পাতাল’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘পোকা-মাকড়’। ঋত্বিকের ইঙ্গিতটা কোনদিকে তা কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না।
লিখন: শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
…… ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর অন্যান্য পর্ব ……
পর্ব ৫৮। নবারুণ চেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজে তিনিও থাকুন, কিন্তু হল না
পর্ব ৫৭। সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক ত্রয়ীর মধ্যে ঋত্বিকের লেখাই আমরা প্রথম ছেপেছিলাম
পর্ব ৫৬। অজয় গুপ্তর নিরন্তর শ্রম আর খুঁতখুঁতে সম্পাদনা ছাড়া মহাশ্বেতা দেবীর রচনাসমগ্র হত না
পর্ব ৫৫। দলকল্যাণের জন্য রাজনীতি সমাজকে নরকে পরিণত করবে, বিশ্বাস করতেন মহাশ্বেতা দেবী
পর্ব ৫৪। যা লিখেছেন, না লিখে পারেননি বলেই লিখেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পর্ব ৫৩। ‘অলীক মানুষ’ তাঁকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নিয়েছে, মনে করতেন সিরাজদা
পর্ব ৫২। নিজের লেখা শহরের গল্পকে লেখা বলে মনে করতেন না সিরাজদা
পর্ব ৫১। কর্নেল পড়ে সিরাজদাকে চিঠি লিখেছিলেন অভিভূত সত্যজিৎ রায়
পর্ব ৫০। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা থেকে বাঁচতে দিব্যেন্দুদার জীবনের দ্বিতীয় গল্পই বদলাতে হয়েছিল
পর্ব ৪৯। রবিশংকর বলের মতো উর্দু সাহিত্যের এত নিবিষ্ট পাঠক খুব কমই দেখেছি
পর্ব ৪৮। দেবেশ রায়ের যেমন ‘বৃত্তান্ত’, আফসার আমেদের তেমন ‘কিস্সা’
পর্ব ৪৭। বই বাঁধানো সম্পূর্ণ হয়নি, তাই ‘মহাভুল’ শুধরে নিয়েছিলেন দেবেশ রায়
পর্ব ৪৬। গান্ধীনগরে রাত্রির কবিই প্রথম বিদ্রুপাত্মক তেতো হাসি এনেছিলেন বাংলা কবিতায়
পর্ব ৪৫। নাটকের মহলা পছন্দ হলে তবেই তিস্তাপারের বৃত্তান্তর অনুমতি দেবেন, বলেছিলেন দেবেশ রায়
পর্ব ৪৪। নিজের বইপত্র বিক্রির বিবরণ দেখে হতাশ হয়েছিলেন দেবেশ রায়
পর্ব ৪৩। থ্রিলার, রহস্য-রোমাঞ্চ কিংবা ক্রাইম স্টোরি অনেক দিন ধরেই বইপাড়ায় ‘সুপারহিট’
পর্ব ৪২। অলংকরণ বা প্রচ্ছদশিল্পীদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই, সখেদে চিঠি লিখেছিলেন নারায়ণ সান্যাল
পর্ব ৪০। সিগারেট ঠোঁটে রথীন্দ্রনাথের ছবি প্রচ্ছদে যাওয়া নিয়ে উঠেছিল প্রবল আপত্তি!
পর্ব ৩৯। শান্তিনিকেতন থেকে কলেজ স্ট্রিট, প্রুফ আদান-প্রদানে সহায়ক ছিলেন বই ব্যবসায়ীরাই
পর্ব ৩৮। পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে সোমেনদা বলেছিলেন, রামকিঙ্করকে নিয়ে এ জাতীয় বই আগে লেখা হয়নি
পর্ব ৩৭। ‘কীর্তির্যস্য’র নাম বদলাতে চেয়েছিলেন ভবতোষ দত্ত
পর্ব ৩৬। কবি-দার্শনিকের বাইরে আরেক রবীন্দ্রনাথকে খুঁড়ে বের করেছিলেন অমিতাভ চৌধুরী
পর্ব ৩৫। ‘শাহজাদা দারাশুকো’ আরও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে ছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের
পর্ব ৩৪। একজন লেখক হিসেবে আমি কি তোমার মনোযোগের যোগ্য নই, অভিমান ভরা চিঠি লিখেছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
পর্ব ৩৩। আমাকে ভাবায়, তারাপদ রায়
পর্ব ৩২। নববর্ষের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ: লেখকদের মন্তব্যের খাতা!
পর্ব ৩১। পরিব্রাজক সন্ন্যাসী তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী ভাগ্যিস থিতু হয়েছিলেন সাহিত্যে!
পর্ব ৩০। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোনও বই আমাকে চাপিয়ে দেননি, লিখেছেন: বিবেচনা করে দেখো
পর্ব ২৯। কবিতাকে শক্তিদা বলতেন ‘জলজ দর্পণ’, তাঁর বেঁচে থাকার অবলম্বন
পর্ব ২৮। পিঁপড়ে কালিতে চুবিয়ে সাদা পাতায় ছাড়া হয়েছে, এমন পাণ্ডুলিপি ছিল বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের!
পর্ব ২৭। নিজস্ব ঈশ্বরভাবনা থাকলেও শঙ্কু মহারাজের লেখার মূল বিষয় ছিল মানুষের আলো-আঁধারি জীবন
পর্ব ২৬। বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও একুশে বইমেলায় কখনও স্টল পাইনি
পর্ব ২৫। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মুহূর্তের রক্ত-ঘাম-হাসি-কান্নার এক জীবন্ত দলিলচিত্র ছেপেছিলাম
পর্ব ২৪। রাখাল ছেলে যেমন বাঁশি বাজায়, আমিও তেমন নিজের খুশিতে লিখি, বলেছিলেন যাযাবর
পর্ব ২৩। রয়্যালটি-মুক্ত বইয়ের ওপর প্রকাশকদের ঝোঁক চোখে পড়ছে বইমেলাতেও
পর্ব ২২: শেষমেশ রেগে গিয়ে আমাকে চিঠিই লিখে ফেলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ!
পর্ব ২১: ৩০০০ কপি বিক্রির মতো জীবিত বা মৃত লেখক আর হয়তো নেই
পর্ব ২০: কম বয়সে আমাদের রোববারের আড্ডা ছিল ২৮ নম্বর প্রতাপাদিত্য রোড, আশুদার বাড়িতে
পর্ব ১৯: ‘লেখা বড় হচ্ছে’ অভিযোগ আসায় খুদে হাতের লেখায় পাণ্ডুলিপি দিতেন প্রবোধবন্ধু অধিকারী
পর্ব ১৮: দু’বছরের মধ্যে সংস্করণ না ফুরলে অন্য জায়গায় বই ছাপার চুক্তি ছিল শরদিন্দুর চিঠিতে
পর্ব ১৭: পূর্ণেন্দু পত্রীর বাদ পড়া প্রচ্ছদ ও দিনেশ দাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ দিনগুলি
পর্ব ১৬: সব প্রকাশনার যাবতীয় বইয়ের হদিশ পাওয়া যেত ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’তে
পর্ব ১৫: নিছকই একটা পত্রিকা নয়, ‘কলেজ স্ট্রীট’ আমাদের আবেগ
পর্ব ১৪: খুদে পাঠকদের জন্য মিনিবই তৈরির কথা প্রথম ভেবেছিলেন অভয়দা
পর্ব ১৩: কয়েকটি প্রেসের গল্প
পর্ব ১২: দীর্ঘায়ু বই ও আইয়ুব পরিবার
পর্ব ১১: প্রেমের নয়, অপ্রেমের গল্প সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন সুনীল জানা
পর্ব ১০: ছোট্ট অপুকে দেখেই রঙিন ছবিতে ভরা টানটান গল্পের বই করার ইচ্ছে জেগেছিল
পর্ব ৯: চানঘরে গান-এ সত্যজিৎ রায়ের চিঠি থাকায় ব্যাপারটা গড়িয়েছিল কোর্ট কেস পর্যন্ত
পর্ব ৮: প্রকাশক-লেখকের কেজো সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহর বিশ্বাস ছিল না
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved