Robbar

নবারুণ চেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজে তিনিও থাকুন, কিন্তু হল না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 7, 2025 5:38 pm
  • Updated:December 7, 2025 9:39 pm  

নবারুণদার সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল। তিনি মনে করতেন নির্দিষ্ট মতাদর্শ ছাড়া সাহিত্য তার পথ হারায়। তা কিন্তু মতাদর্শ প্রচার নয়– বরং ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন। তিনি ছাত্রজীবনে নকশালপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তী জীবনেও সিপিআই(এম এল) লিবারেশনের সদস্য ছিলেন বলেই জানি। তবে তাঁর লেখক হওয়ার গোড়ার কথাটা তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন– “এ কথা সত্যি যে আমার পারিবারিক পটভূমি এমনটাই ছিল, কিন্তু আমার ভেতরের কিছু প্রয়োজনীয়তাও ছিল, যারা আমাকে লেখালেখির দিকে ঠেলে দিল।”

সুধাংশুশেখর দে

৫৮.

১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে সরলা রায় মেমোরিয়াল হলে ঋত্বিক ঘটকের ৫২-তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় বিজন ভট্টাচার্য বলেছিলেন– ‘…লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সমাজ-সচেতন চলচ্চিত্রকারদের গুলি করে মারা হচ্ছে।… আর ঋত্বিককে মারা হয়েছে পরোক্ষে। তাঁকে খুন করা হয়েছে। হ্যাঁ, আমি মনে করি, তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।…’ আসলে তিনি বোঝাতে চাইছিলেন আমাদের সমাজের ধারক-বাহকেরা কীভাবে ঋত্বিকের চলচ্চিত্র-সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। ঋত্বিকও কিন্তু বিজন ভট্টাচার্য সম্পর্কে একই রকম উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। ‘নাট্যদর্পণ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়, ১৯৭৫-এর মে মাসে, ‘বিজন ভট্টাচার্য: জীবনের সূত্রধার’ রচনায় ঋত্বিক বলেছিলেন–

“সবারই জানা আছে বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা দেশে গণনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত। সকলেই জানেন ‘নবান্ন’-এর কথা। কিন্তু এটা সাধারণত জানা নেই যে, ‘নবান্ন’ নাটকটির জন্ম হয় ‘আগুন’ বলে একটি একদৃশ্যের ছোট্ট নাটিকার থেকে। তার অভাবনীয় সাড়া জাগানো দেখে বিজনবাবু লেখেন ‘জবানবন্দী’ বলে একাঙ্ক। সেটাও মানুষকে অভিভূত করে, এবং তারই বিস্তারিত রূপ ‘নবান্ন’।
শুধু রচনাশৈলীর দিক থেকে নয়, প্রয়োগ এবং অভিনয়পদ্ধতির দিক থেকেও বিজনবাবু বিপ্লব আনেন আমাদের মঞ্চে। বঙ্গভূমি রত্ন-প্রসবিনী। তাঁর থেকে মহৎ ও মহীয়ান অভিনয়শিল্পী তাঁর আগে বহু জন্মে গেছেন এই বাংলা দেশে। তফাতটা সেখানে নয়। তফাতটা হচ্ছে– অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, গিরিশ ঘোষ থেকে আরম্ভ করে শিশির ভাদুড়ী পর্যন্ত মহারথী ছিলেন একক সূর্যের উপাসক। ব্যক্তিগত অভিনয়প্রতিভার স্ফুরণের দিকেই তাঁদের ছিল ঝোঁক এবং প্রয়োগকর্তা হিসেবে তাঁরা বিভিন্ন মঞ্চকে সম্পূর্ণ আপন বশে রেখে নাট্যকারদের দিয়ে নাটক লেখাতেন এবং নিজেদের বিকাশের সমস্ত পথ খুলে নিতেন। ফলে তখনকার নাট্যপ্রয়োগ ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তার সঙ্গে আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যভিচারগ্রস্ত জমিদারশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় পরিপুষ্ট এক বিশেষ ধরনের নটীরা সুযোগসুবিধে পেতেন। তখনকার বিভিন্ন মঞ্চকে ঘিরে যে ক্লেদাক্ত ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি হত, তার কিছু কিছু রেশ আমরাও দেখেছি।
ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা বলব না– কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই। প্রধান ধারাটি ছিল ওই কলুষিত আবহাওয়াতে পর্যবসিত। তার থেকেও বড়ো কথা, নাটক যে সামাজিক মানুষের সংগ্রামের অংশীদার শুধু নয়, হাতিয়ারও বটে– এ-বোধ ছিল অনুপস্থিত।
এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বিজনবাবুর নেতৃত্বে গণনাট্য সংঘের আবির্ভাব। তখন প্রথমে নাটক আরম্ভ হয় ফ্যাসিবিরোধী লিগের ছত্রছায়ায় প্রগতি লেখক সংঘের নামে। কিছু বাদে তারই শাখা হিসেবে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের জন্ম।
বিজনবাবুই প্রথমে দেখালেন কী করে জনতার প্রতি দায়িত্বশীল হতে হয়, কী করে সম্মিলিত অভিনয়ধারার প্রবর্তন করা যায় এবং কী করে বাস্তবের একটা অংশের অখণ্ড রূপ মঞ্চের ওপর তুলে ধরা যায়। আমরা যারা তখন চেষ্টা করেছিলাম, সে-সব দিনের কথা ভুলব না। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আলোড়ন বাংলার একপ্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টবৎ শিহরিত করে তুলল।
বাংলা নাটকে এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল।…”

এই লেখার শেষে ঋত্বিক স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় মন্তব্য করেছেন– ‘এবং তিনি নাম করা নিয়ে ব্যস্ত নন। একটা কিছু নাম দিয়ে একটা ইস্কুল তৈরি করা, এটা ওঁর ধাতে আসে না।… অর্থাৎ ভদ্রলোক চালবাজি শেখেননি।’

বাংলা নাটকের জগতে বিজন ভট্টাচার্য একজন বিশিষ্ট নাটককার, নির্দেশক ও অভিনেতা। তাঁর চলচ্চিত্রে অভিনয়ও ভোলা যায় না। বিশেষ করে ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেনের ছবিতে। ঋত্বিকের আটটির মধ্যে পাঁচটি ছবিতেই বিজন ভট্টাচার্য অভিনয় করেছেন। আবার মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’ ছবিতে বাবার চরিত্রে তাঁর অভিনয়ের কোনও তুলনা হয় না।

বিজন ভট্টাচার্য

বিজন ভট্টাচার্যের বই আমি করেছি অনেক পরে। সেসবই নতুন শতকে পৌঁছে এবং এই বইগুলি করার মূল উদ্যোগ অপুর। অজয়দা (অজয় গুপ্ত) একদিন জানালেন নবারুণ ভট্টাচার্য দে’জ পাবলিশিং থেকে বই করতে আগ্রহী। অজয়দা ছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্যের বন্ধু। সোভিয়েত কনসুলেটে সহকর্মীও। এমনকী, নবারুণদার স্ত্রী প্রণতি ভট্টাচার্য ‘বাবার চেয়েও বেশি’ নামে একটি গদ্যে জানিয়েছেন তাঁদের বিয়েতে বরযাত্রী ছিলেন– বিভূতি মুখোপাধ্যায়, বিদ্যুৎ হালদার, প্রবীর বসু, সুবীর বসু এবং অজয় গুপ্ত।

ততদিনে দে’জ থেকে মহাশ্বেতাদির অনেক বই, রচনাসমগ্রের ছ’-সাতটা খণ্ড প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। অজয়দার সূত্র ধরেই নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেল তিনি শুধু নিজের নয়, তাঁর বাবার বেশ কয়েকটা বইও আমাদের দিতে চান। যদিও সেসবই পূর্বপ্রকাশিত বই। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সেই বিশেষ সম্পদগুলিকে রক্ষা করাটা আমাদের কর্তব্য বলেই মনে হয়েছিল।

দে’জ থেকে বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম বই বেরয় ২০০৩ সালের বইমেলার সময়– ক্রাউন সাইজের পেপারব্যাকে বিজন ভট্টাচার্যের নাটক ‘দেবীগর্জন’। নাটকটি বিজনবাবু উৎসর্গ করেছিলেন– ‘কৃষক আন্দোলনের শহিদদের উদ্দেশে’। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিস্তারিত মুখবন্ধ-সহ আরও কিছু প্রাসঙ্গিক লেখা ও তথ্য দিয়ে বইটি সাজানো হয়।

বিজন ভট্টাচার্য এবং নবারুণদার অনেকগুলি বই ‘প্রমা’ থেকে সুরজিৎ ঘোষ প্রকাশ করেছিলেন। মহাশ্বেতাদিরও কয়েকটি বই ছিল প্রমা-য়। সুরজিৎ ঘোষ ছিলেন নবারুণদার বিশেষ বন্ধু। সুরজিৎ ঘোষের নিরন্তর তাগাদাতে তিনি ‘হারবার্ট’ লিখেছিলেন। কিন্তু আমি যে-সময়ের কথা বলছি তখন সুরজিৎদা অসুস্থ হওয়ায় প্রমা-র কাজ হয়তো খানিকটা অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। যাই হোক, দে’জ থেকে ‘দেবীগর্জন’ প্রকাশিত হয়ে যাবার পরই তিনি প্রমার স্বত্বাধিকারী সুরজিৎ ঘোষকে চিঠি দিয়ে একসঙ্গে অনেকগুলি বই প্রমা থেকে তুলে নেন। সেই চিঠি এবং তার উত্তরে সুরজিৎ ঘোষের লেখা চিঠির কপি আমার ফাইলে রাখা আছে। নবারুণদা ২০০৩-এর ৩ জুলাই সেই চিঠিতে লিখেছিলেন–

‘শ্রী সুরজিৎ ঘোষ,

প্রমা
৫ ওয়েস্ট রেঞ্জ
কলকাতা– ৭০০০১৭
সমীপেষু

মহাশয়,

এতদ্বারা আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমার পিতা প্রয়াত বিজন ভট্টাচার্য, মা মহাশ্বেতা দেবী এবং আমার নিজের একাধিক গ্রন্থেরই ‘প্রমা’-র পক্ষ থেকে বর্তমান প্রকাশক আপনি। গ্রন্থগুলির তালিকা এরকম–

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আপনাকে জানাতে বাধ্য হচ্ছি, ইচ্ছুক ক্রেতারা উল্লিখিত গ্রন্থগুলি বাজার থেকে সংগ্রহ করতে পারছেন না বলে আমাকে জানাচ্ছেন। ফলে, সঙ্গত কারণেই আমার বিশ্বাস, গ্রন্থগুলি বর্তমানে বাজারে নেই। হয়, কোনো কারণবশত গ্রন্থগুলি বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজারে দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, নতুবা গ্রন্থগুলির চলতি সংস্করণ নিঃশেষিত হয়েছে।

এবংবিধ পরিস্থিতিতে আপনার কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ এই যে, যদি ওই গ্রন্থগুলির কোনো অবিক্রীত কপি– বাঁধাই অথবা অ-বাঁধাই– আপনার কাছে থেকে থাকে তাহলে সেগুলি আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। একই সঙ্গে, এই কথাও আপনাকে জানাচ্ছি যে, উক্ত গ্রন্থগুলির একটিরও নতুন কোনো সংস্করণ আপনি আর ছাপবেন না। গ্রন্থগুলির স্বত্বাধিকারী হিসেবে এটিকে আপনি আমার নির্দেশ বলে গ্রহণ করতে পারেন, যা এই পত্র লেখার তারিখ (৩.৭.২০০৩) থেকেই কার্যকর হচ্ছে। আর, অবিক্রিত বই/ফর্মা যদি থাকে তাহলে তা পত্র লেখার তারিখ থেকে এক মাসের মধ্যে (৩.৮.২০০৩) আমার কাছে পৌঁছনো বাঞ্ছনীয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুরো বিষয়টি নিয়ে আমাকে নতুন ভাবে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। আশা করি, সত্বর যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে আপনি আমার পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়তা করবেন।…’

এর উত্তরে ২০০৩-এর ২৩ অক্টোবর সুরজিৎদা জানিয়েছিলেন–

‘Shri Nabarun Bhattacharya,
AS1/1, Golf Green,
Kolkata-700 095.

Dear Sir.

This has reference to your letter dated 3rd July 2003 which I received in the first week of July but immediately thereafter I was  gravely ill and was receiving treatment at Barasat Cancer Institute. When I came home your letter completely escaped my attention and hence I could not respond to the same at that time. By chance I came across your aforesaid letter while I was trying to sort out my papers and immediately I decided to respond. This delay is wholly unintentional and was caused by compelling circumstances.
Your information about the non-availability of certain titles in market as listed by you is incorrect. 8 titles out of the 13 nos listed by  you are very much available. Other titles have been out of print for atleast last 8 years and you are well aware of this fact.
Out of 13 titles mentioned by you copyright of 6 titles belong to Smt. Maheswata Devi. Regarding those titles, only Smt. Mahasweta Devi is competent to issue necessary instructions.
Regarding the titles of Bijan Bhattacharya and yourself please note that your item No. 9 ie. “Halal Jhanda” is out of print for more than last 10 years now. You are fully aware of this and you have already used some of the stories of that collection in your other publications. Out of other six titles i.e. your item nos. 1,2,10,11,12 and 13 you have received royalty for 5 titles 1,2,10,11 & 13 upto 31st March 2003. You duly granted a receipt after accepting the royalty statement dated 31 March 2003. No payment was made for item 12 as only 3 copies were sold. Your publisher is Proma Prakashani and not Proma.
Please be informed that we are not publishing any new edition of the aforesaid seven titles. So far as unsold copies are concerned you are always welcome to take those unsold copies back, bound and unbound upon payment of the price calculated on the basis of the market price after allowing 25% discount and 10% royalty payable to you only on sale. We can discuss this sometime in the 1st week of November 2003 when the binders will open their workshops and will be in a position to make the unsold copies available if so desired.

With kind regards…’

লেখক-প্রকাশক কোনও তরফেই এ নিয়ে কোনও বড় কোনও বিসংবাদ হয়নি বলেই জানি। তবে এমনও নয় যে প্রতিটি বই পরবর্তী সময়ে দে’জ থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। তবে ‘দেবীগর্জন’-এর পর ২০০৪-এর বইমেলার সময় আমি দে’জ থেকে প্রকাশ করেছিলাম– বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’। এই বইটিরও শুরুর লেখাটি শমীকদার। নতুন দে’জ সংস্করণে ‘প্রকাশকের নিবেদন’-এ আমি লিখেছিলাম–

“বাংলা নাটকে এবং নাট্যমঞ্চে বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘নবান্ন’ এক ‘দিশারী জয়স্তম্ভ’। ৬০ বছর আগে প্রথম প্রকাশিত এই নাটকটির ইতিপূর্বে পাঁচটি বাংলা এবং একটি হিন্দি সংস্করণ বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হলেও, আমাদের সংস্থা এই প্রথম কালোত্তীর্ণ এই নাটকটি প্রকাশ করার গৌরব অর্জন করল। ‘নবান্ন’র সর্বশেষ বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ খ্রি.। নাটকটির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করার সময় আমরা পূর্ববর্তী সংস্করণের হুবহু পুনর্মুদ্রণ না করে, নানাদিক থেকে নাটকটিকে পাঠক-সাধারণের অধিকতর উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করেছি।
সংক্ষেপে, বর্তমান সংস্করণে সংযুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি এইরকম– ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ এবং ২০০০ সালে প্রকাশিত শেষ সংস্করণের পাঠ মিলিয়ে, ছোট-বড় ত্রুটি, অসঙ্গতি দূর করে বর্তমান সংস্করণের পাঠ প্রস্তুত করা হয়েছে।

বিগত ৬০ বছরে ‘নবান্ন’ নাটক ও নাট্যকার-অভিনেতা-পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য প্রসঙ্গে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য প্রবন্ধ-আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। ‘গ্রন্থপ্রসঙ্গ’ অংশে আমরা নির্বাচিত কয়েকটি রচনা সংযোজিত করেছি: ‘অভিনয় দর্পণ’ পত্রিকা থেকে দুটি, ‘গন্ধর্ব’– বিজন ভট্টাচার্য: বাংলার থিয়েটার আন্দোলন/আশ্বিন ১৩৮৪– থেকে দু’টি এবং ‘বহুরূপী’ নবান্ন-স্মারক সংখ্যা (দ্বিতীয় সংকলন), জুন ১৯৭০ থেকে চারটি। সবশেষে যুক্ত হল শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অন্ত্যবন্ধ’ যা এই সংস্করণের জন্যই নতুন করে লেখা।…”

স্ত্রী-পুত্র-সহ বিজন ভট্টাচার্য

‘নবান্ন’ও ‘দেবীগর্জন’-এর মতো পেপারব্যাকেই প্রকাশিত হলেও বইটি করা হয় ১/৮ ডিমাই সাইজে। ‘নবান্ন’ ছাপার পর থেকেই বিজনবাবুর যাবতীয় রচনার সংকলন দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশের ব্যাপারে আমাদের ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। গোটা পর্যায়টাতে নবারুণদা, শমীকদা এবং অজয়দাও ছিলেন। শেষ পর্যন্ত স্থির হয় নবারুণ ভট্টাচার্য এবং শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় দু’জনে মিলে এই রচনাসংগ্রহ সম্পাদনা করবেন। প্রাথমিক আলোচনায় ঠিক হয়েছিল মোট তিন খণ্ডে কাজটি হবে। প্রথম দু’টি খণ্ডে থাকবে বিজন ভট্টাচার্যের যাবতীয় নাটক আর পরের খণ্ডটিতে তাঁর গল্প, উপন্যাস, গান, নির্বাচিত সাক্ষাৎকার এবং চিঠিপত্র। ২০০৮-এর জুলাই মাসে বিজন ভট্টাচার্যের জন্মদিন ১৭ তারিখেই আমরা বইটি উদ্বোধন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নানা কারণে অনুষ্ঠানটির দিন স্থির হয় ২৩ জুলাই। বাংলা আকাদেমি সভাঘরে বইটির উদ্বোধন হয়। সেদিনের সভায় মহাশ্বেতাদিও এসেছিলেন। নবারুণদা বিজনবাবুর স্মৃতিচারণ করেছিলেন।

তবে সেদিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল বিজন ভট্টাচার্যের কণ্ঠে ‘জীয়নকন্যা’ নাটকের পাঠ শোনা। অনুষ্ঠানের কিছুদিন আগে শমীকদার মনে পড়ে– অনেক দিন আগে বোধহয় নীহাররঞ্জন রায়ের বাড়িতে বিজনবাবু ‘জীয়নকন্যা’ পড়ে শোনান। সেদিন নাটকের গান গেয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। শমীকদা আর তাপস সেনের উদ্যোগে সেদিনের পাঠ স্পুল-রেকর্ডারে ধরা ছিল। সেই রেকর্ডিং রাখা ছিল ‘নাট্য শোধ সংস্থান’-এ। শমীকদা অপুকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গিয়ে স্পুল উদ্ধার করেন। কিন্তু সেটা চালানোর মতো যন্ত্র পাওয়া কঠিন ছিল। হঠাৎ অপুর মাথায় খেলে যায়– আকাশবাণী ভবনে ছেলেবেলায় সে এরকম যন্ত্র দেখেছিল। তখন আকাশবাণীতে কর্মরত ছিলেন লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। তাঁকে ফোন করায় তিনি জানান, আকাশবাণীতে তখনও সেরকম কয়েকটা যন্ত্র অবশিষ্ট আছে। অপু শমীকদাকে সঙ্গে নিয়ে তক্ষুনি আকাশবাণী যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায় সেই পুরনো স্পুলের অবস্থা বেশ খারাপ। অনেক জায়গা ছিঁড়ে গিয়েছে, কোথাও জড়িয়ে গিয়েছে। যাই হোক, রেকর্ডিং চালাতেই বিকট শব্দ শুরু হয়। অপুর তখন মাথায় হাত। কেননা অনুষ্ঠানের আর চার-পাঁচ দিন বাকি ছিল। আর আমন্ত্রণ পত্রে লেখা হয়ে গিয়েছিল বিজন ভট্টাচার্যের স্বকণ্ঠে ‘জীয়নকন্যা’ শোনানো হবে। তখন আসরে অবতীর্ণ হন স্বপ্নময়দার সহকর্মী কয়েকজন সাউন্ড এঞ্জিনিয়ার। তাঁরা বলেন, দিন দুয়েক সময় পেলে ব্যাপারটা ঠিক করার চেষ্টা করা যেতে পারে। সেই মতো শমীকদা আর অপু ফিরে আসে। কিন্তু দু’-দিন পরে আকাশবাণীতে গিয়ে অপু পেয়ে যায় বিজন ভট্টাচার্যের পাঠ করা নাটকের সিডি। আকাশবাণীর সেই প্রকৌশলীরা অসম্ভব যত্ন ও দক্ষতায় কাজটা করে দিয়ে বাংলার সংস্কৃতির অত্যুজ্জ্বল একটি রত্নকে চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন।

বিজন ভট্টাচার্যের ‘রচনাসংগ্রহ’-এর এখনও পর্যন্ত একটিই খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। সেই খণ্ডে আছে– ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’, ‘নবান্ন’, ‘অবরোধ’, ‘মরাচাঁদ’(একাঙ্ক), ‘জীয়নকন্যা’, ‘কলঙ্ক’, ‘জননেতা’, ‘জতুগৃহ’, ‘গোত্রান্তর’ এবং ‘মরাচাঁদ’। প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেন ‘আগুন’ সম্পর্কে বিজনবাবু তাঁকে বলেছিলেন– ‘এই শহরের উপর যুদ্ধের ভয়ংকর ছায়াপাতের একটা লক্ষণ দেখেছিলাম কিউইং-এর মধ্যে– জলের কিউ, চালের কিউ। র‍্যাশন বয়-দের যেন একটা শ্রেণিই গড়ে উঠেছিল। এই ব্যাপারটা নিয়েই খণ্ড খণ্ড কয়েকটি চিত্র রচনা করেছিলাম।’ আর ‘জবানবন্দী’ নাটক প্রসঙ্গে তিনি শমীকদাকেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন– ‘ডি এন মিত্র স্কোয়েরের পাশ দিয়ে রোজ আপিস যাই। রোজই দেখি, গ্রামের বুভুক্ষু মানুষের সংসারযাত্রা। নারী-পুরুষ-শিশুর সংসার। দেখি বললে ঠিক বলা হবে না। আমি লজ্জায় চোখ তুলে ওদের দিকে তাকাতে পারতাম না। চোখ না তুলেও যেতে যেতে ওদের উপস্থিতি টের পেতাম। এক একদিন রাস্তার ওপরেই শায়িত মৃতদেহ, নোংরা কাপড়ে ঢাকা। মৃতদেহগুলো যেন জীবিত মানুষের চেয়ে অনেক ছোটো দেখায়। বয়স্ক কি শিশু, আলাদা করা যায় না। আপিস যাওয়ার পথে অন্য দৃশ্য দেখি। টেলিগ্রাফের তার কাটতে গিয়ে পুলিশের গুলি খেয়ে পাকা ফলের মতো টুপ করে রাস্তায় পড়ে অল্পবয়সি ছেলে। আমি নিজেও একদিন কলেজ স্ট্রিটে পুলিশের প্রচণ্ড মার খেলাম। আপিস থেকে ফিরবার পথে রোজই ভাবি, এই সবকিছু নিয়ে লিখতে হবে। কিন্তু কীভাবে লিখব? ভয় করে, গল্প লিখতে গেলে সে বড়ো সেনটিমেন্টাল প্যানপেনে হয়ে যাবে। একদিন ফেরবার পথে কানে এল, পার্কের রেলিঙের ধারে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজোপার্বণের গল্প, ভাববার চেষ্টা করছে, তাদের অবর্তমানে গ্রামে তখন কী হচ্ছে। আমি আমার ফর্ম পেয়ে গেলাম। নাটকে ওরা নিজেরাই নিজেদের কথা বলবে।’

নবারুণ ভট্টাচার্য

প্রসঙ্গত একটা তথ্য জানিয়ে রাখি বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ নাটকেই তৃপ্তি মিত্র প্রথমবার মঞ্চে নামেন। ‘বহুরূপী’ পত্রিকার নবান্ন-স্মারক সংখ্যায় তিনি লিখছেন–

‘আমি জীবনে অভিনয়ের দিকে যাব এমন ভাবনাই আমার ছিল না। তখন ১৯৪৩ সাল।
আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট বেরোবার আশায় বসে আছি। এমন সময় আগুন-এর শিল্পীদের মধ্যে থেকে একজন মেয়ে চলে গেল। তখন অভিনয় হতে আর সাত দিন বাকি। গোষ্ঠদা তখন খুব মুশকিলে পড়ে গেলেন।… তখন আমায় আগুন-এর ঝগড়াটে বউয়ের পার্টটি দেওয়া হয়।

নাট্যভারতীতে (বর্তমান গ্রেস সিনেমা) সাত দিন পরে ঠিক তারিখেই অভিনয় হল। পাবলিক স্টেজে এই আমার প্রথম অভিনয়।’

 

বিজন ভট্টাচার্যের বইয়ের কাজের সঙ্গে-সঙ্গেই আমরা নবারুণ ভট্টাচার্যের বই করতেও শুরু করি। প্রথম ছেপেছিলাম তাঁর তোলপাড় ফেলে দেওয়া উপন্যাস ‘হারবার্ট’। ২০০৪-এর জানুয়ারিতে বইটি দে’জ থেকে প্রকাশের আগেই তিনটে বড় পুরস্কার পেয়ে গিয়েছে। এর পর ২০০৬-এর বইমেলায় ‘মসোলিয়ম’, সে-বছরের পয়লা বৈশাখে ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ এবং তার পরের বছর বইমেলায় ‘অটো ও ভোগী’ প্রকাশিত হয়।

১৯৯২ সালের পুজো সংখ্যা ‘প্রমা’য় ‘হারবার্ট’ প্রকাশের পরেই বাংলা সাহিত্যজগতে আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। যদিও নবারুণদা আদৌ নবাগত লেখক ছিলেন না। কবিতা-গল্প তার আগেও লিখেছেন। তাঁর ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ তো মানুষের মুখে মুখে প্রবাদের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ‘হারবার্ট’ প্রকাশের পর সবাই চমকে যায়। এত ছোট একটা উপন্যাস, অথচ এত অভিনব। শঙ্খদা ১৯৯৬-এর ১৩ অক্টোবর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ‘রবিবাসরীয়’তে ‘সারহীন সম্ভার’ নামে লেখাটিতে শারদ সংখ্যার আয়োজনে আমাদের প্রাপ্তি কী তা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন– “…নতুন কেউ লিখলে সেটা পড়বার একটা আগ্রহ জাগে প্রথমে, আর সে-আগ্রহের বেশ তৃপ্তিজনক ফলও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। এই যেমন কয়েক বছর আগে ‘প্রমা’ পত্রিকার শারদীয়তে ছাপা হল একটি উপন্যাস ‘হারবার্ট’, লেখকের নাম নবারুণ ভট্টাচার্য। গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনও একটিমাত্র স্মরণীয় উপন্যাসের নাম যদি বলতে হয় তো নিশ্চিতভাবেই বলব এই ‘হারবার্টে’র কথা।” দেবেশদা (দেবেশ রায়) আবার ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার মে ১৯৯৪ সংখ্যার জন্য নবারুণদার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তাতে শুরুর কথায় তিনি লিখেছিলেন– “১৯৯৩-এর বইমেলাতে নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর ‘হারবার্ট’ নামের মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার উপন্যাসটিতে আমাদের চমকে দিলেন, একটু আকস্মিকভাবেই (প্রকাশক প্রমা প্রকাশনী ৫৭/২ই কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০৭৩)। এ উপন্যাসের কোথাও কোনো ইতস্তত নেই, লেখকই লিখতে লিখতে উপন্যাসটিকে জানতে পারছেন এমন কোনো অনিশ্চয়তা নেই। গল্পটা বাড়তে বাড়তে নিজের গতিতে একটা আকার নিচ্ছে এমন কোনও স্বাভাবিকতা নেই। মনে হল, লেখাটির অনেকগুলো খসড়া করে লেখক আগে জেনে নিয়েছেন তিনি কী লিখছেন ও কেন লিখছেন। তাই উপন্যাসটি এতটা মেদহীন। লেখক নিজে নিজের রচনাটিকে অনেক আগে থেকে জেনে আসছেন– এই পূর্বজ্ঞান উপন্যাসটির ভিতরে এক প্রজ্ঞার আভা ছড়িয়ে দেয়। আর উপন্যাস মানে কাহিনী, এই হ্রস্বকায় রচনাটিতে এমন একটি লাইনও প্রায় নেই যে-লাইনে কাহিনী এগোচ্ছে না, কাহিনী নতুন গতিমুখ পাচ্ছে না। বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিক কালে ‘হারবার্টের’ মতো মৌলিক উপন্যাস লেখা হয়নি।” ২০০৬ সালে সুমন মুখোপাধ্যায় ‘হারবার্ট’ নামেই একটি অসামান্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। আগেই একবার উল্লেখ করেছি দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ নাটক আর ‘হারবার্ট’ চিত্রনাট্য আমরা একত্রে প্রকাশ করেছি ২০২৪ সালে। ‘হারবার্টে’র চিত্রনাট্যটি সম্ভবত এর আগে ২০০৬ সালেই নবারুণ ভট্টাচার্যের পত্রিকা ‘ভাষাবন্ধন’-এর উৎসব সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল।

 

নবারুণদা মনে করতেন গদ্য এবং কবিতা দু’-ক্ষেত্রেই লেখকের একটা পূর্ব পরিকল্পনা থাকতে পারে। তাঁর ভাষায়– ‘দুটোতেই পরিকল্পনা থাকতে পারে। অসুবিধের কিছু নেই। কিন্তু ইনিসিয়াল ইম্পেটাসটা কোথা থেকে আসবে সেটা বলা কঠিন। কিন্তু তারপর, বাকিটুকু হচ্ছে মিস্ত্রির কাজ, এখন মিস্ত্রির কাজও তো পরিকল্পনা না করে হবে না। মিস্ত্রি ইচ্ছে করলেও ছাদ আগে বানাতে পারবে না। লেখাটা একটা স্ট্রাকচার। ক্রিস্টাল যেমন একটা স্ট্রাকচার, পৃথিবীর তলায় লেয়ারগুলো যেমন একটা স্ট্রাকচার, এটাও তেমনি এক স্ট্রাকচার। তাই এই স্ট্রাকচারটা বুদ্ধিহীনভাবে, শুধু প্যাশনের ওপর নির্ভর করে লেখা যায় না।’

নবারুণদার সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল। তিনি মনে করতেন নির্দিষ্ট মতাদর্শ ছাড়া সাহিত্য তার পথ হারায়। তা কিন্তু মতাদর্শ প্রচার নয়– বরং ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন। তিনি ছাত্রজীবনে নকশালপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তী জীবনেও সিপিআই(এম এল) লিবারেশনের সদস্য ছিলেন বলেই জানি। তবে তাঁর লেখক হওয়ার গোড়ার কথাটা তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন– “এ কথা সত্যি যে আমার পারিবারিক পটভূমি এমনটাই ছিল, কিন্তু আমার ভেতরের কিছু প্রয়োজনীয়তাও ছিল, যারা আমাকে লেখালেখির দিকে ঠেলে দিল। বাইরের কোনো চাপ নয়, প্রথমে তো আমি লিখতামই না, রাজনীতির কর্মীই ছিলাম। রাজনৈতিক সক্রিয়তা চলাকালীন আমার পড়াশুনোর কেরিয়ারটা বরবাদ হয়ে গেল। একদিন খুব হতাশ হয়ে আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা এবার আমি কী করব?’ তো বাবা বললেন যে, তুমি লিখবে। কিন্তু খেয়াল রেখো এ কথা যে কখনোই পয়সা কামানোর জন্য লিখবে না।’ বাবার এই কথা আমি মনে রেখেছি আর আজ পর্যন্ত কখনোই পয়সা কামানোর জন্য লিখিনি। জীবিকার জন্য সাংবাদিকতা করেছি, আর লেখালেখিকে জীবিকার সঙ্গে জুড়িনি।…”

২০১০-এর বইমেলার সময় দে’জ থেকে প্রকাশিত হয় নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘উপন্যাসসমগ্র’। ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন–  ‘আমার আটটা ছোট-বড় উপন্যাস নিয়ে এই সংকলন। কেউ চাইলে এবার একটি সসীম মুদ্রিত পরিসরে আমার আখ্যান, তার ব্যর্থতা ও সফলতা, একাধিক ধাঁচের বাচনের মধ্যে আমার অস্থির সন্ধান, কোনও মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক যোগসূত্র আছে না নেই, জটিল ও ধ্বস নামার সময়ে দাঁড়িয়ে কোনও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা আমি করতে পেরেছি কি না, আমার বিশ্ববীক্ষা, প্রাণমণ্ডলের সঙ্গে একটা সক্রিয় অঙ্গীকার– সবটাই যাচাই করে নিতে পারবেন। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, যে তাগিদ থেকে আমি লিখি তার সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক রদবদলের যে বিচিত্র ও ট্রাজিক সময়ের আমি সাক্ষী তার অনুরণন আমার আখ্যানে রয়েছে– কখনও আমি অংশীদার এবং সব সময়েই ভিক্টিম। তৃতীয় বিশ্বের একজন লেখক হিসেবে সেটাই আমার উপলব্ধি। বিচ্ছিন্নতার কষ্টকর একাকিত্ব থেকে কোনো একটা অন্বয়ে আমার যাওয়ার চেষ্টা আশা করি পাঠকের চোখ এড়াবে না। অমানবিকতা ও তৎসংশ্লিষ্ট আবশ্যিক যে বুজরুকির সার্কাসের মধ্যে আমরা রয়েছি তার সঙ্গে কোনোরকম আপোষ অসম্ভব। এটাই আমার ও আমার আটটি আখ্যান– এই ন’জনের সম্মিলিত ঘোষণা।’

একসময় বাঙালি পাঠক নবারুণদার ‘ফ্যাতাড়ু’দের নিয়ে রীতিমতো মজে ছিল। আবার আরেকটি অংশের মত ছিল সাহিত্যে স্ল্যাং-এর এমন প্রয়োগ নবারুণ করছেন যা তাদের রুচিতে অস্বস্তিকর। এ-ব্যাপারেও লেখকের স্পষ্ট মতামত ছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন– ‘…আমার মনে আছে, আমি যখন বঙ্কিম পুরস্কার পেলাম, তখন একজন আমাকে বলেছিলেন, শুধু খিস্তি লিখে বঙ্কিম। এতে আমার মনে হয়, এই যে স্ল্যাং নিয়ে আমাদের এই সমালোচনা বা অসমালোচনা– সবটার মধ্যেই আমাদের একটা চূড়ান্ত ইমম্যাচিওরিটির লক্ষণ ধরা পড়ে। দ্বিতীয়ত, আমরা যেহেতু বহুদিন আগে আমাদের সাহিত্যজগৎ থেকে টেকচাঁদ, ভবানীচরণ বা হুতোমকে নির্বাসন দিয়েছি, সেহেতু তার কোনো ধারাবাহিকতা আমাদের সাহিত্যে বর্তায়নি। যদি বর্তাত তাহলে স্ল্যাং নিয়ে এ ধরনের কথা উঠত না। আজকে আমেরিকান সাহিত্য বা রাশিয়ান সাহিত্যে স্ল্যাং ইউজ করা নিয়ে কোনো কথা হয় না। সেখানে স্ল্যাং ইজ জাস্ট আ পার্ট অব দ্য লিভিং ল্যাঙ্গুয়েজ। আমিও সেভাবেই দেখি। এ নিয়ে কথা বলা আমার মনে হয় খুব একটা প্রাপ্তমনস্কের লক্ষণ নয়।’

আসলে নবারুণ ভট্টাচার্য ছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিকল্পের সন্ধানী। তিনি মনে করতেন বিকল্প খুঁজতে ভয় পেলে লেখক হওয়া যায় না। একটি লেখায় কার্লোস ফুয়েন্তেস-এর ‘দ্য ওল্ড গ্রিঙ্গো’ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন– ‘ইট ইজ নট ডিফিকাল্ট টু বি ব্রেভ, হোয়েন ইউ আর নট অ্যাফ্রেড টু ডাই’। তিনি বিশ্বাস ছিল– ‘আমরা একটা মিথ্যে, একটা ভ্রান্তি [য.] একটা উলটো পথে চালিয়ে দেওয়া পৃথিবীতে রয়েছি।’

 

‘উপন্যাসসমগ্র’ প্রকাশের বছর দুয়েক পর একদিন বিকেলে নবারুণদা অপুকে ফোনে মজার সুরে বলেন, দে’জের ক্যাটালগে এত কবির ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ আছে অথচ তাঁর নেই কেন? অপু পালটা জানায় তিনি পাণ্ডুলিপি দিলেই তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ছাপা হবে। তারপর একদিন ফের তিনি ফোন করে জানান পাণ্ডুলিপি বানাতে গিয়ে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ না হয়ে ‘কবিতাসমগ্র’ হয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি আরও কিছুদিন সময় নিয়ে কাজটা করবেন বলে জানান। কিন্তু তারপর ধীরে-ধীরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন। ২০১৪-র ৩১ জুলাই তিনি আমাদের ছেড়ে যান। দিনটা মনে আছে, কেননা তার পরদিন সকাল-সকাল শঙ্খদা অপুকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন– নবারুণদার মৃতদেহ কলেজ স্ট্রিটে আনা হচ্ছে কি না। অপু তখন নবারুণদার বাড়িতে যোগাযোগ করে সে-ব্যবস্থা করে। শেষযাত্রায় শববাহী গাড়িতে তাঁকে আমাদের দোকানের সামনে আনা হয়। শঙ্খদা সেদিন এসেছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্যকে শেষবারের মতো দেখতে।

২০২৫-এর বইমেলায় রাজীব চৌধুরীর সম্পাদনায় দে’জ পাবলিশিং থেকে নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কবিতাসমগ্র’র ১ম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে প্রণবেশ মাইতির প্রচ্ছদে। হঠাৎ খেয়াল হল, এই বইটি ছাড়া দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত বিজন ভট্টাচার্য আর নবারুণ ভট্টাচার্যের যাবতীয় বইয়ের মলাট করেছেন অজয়দা।